বনানীর ধর্ষণ মামলায় ফের বের হলো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য



বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনা বদলে দিয়েছে নির্যাতিতাদের জীবন।  আগের মতো চঞ্চলতা নেই তাদের।  বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না।  ঘটনার অনেক দিন পর চুপিসারে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাচ্ছেন।  তবে আগের মতো বন্ধুদের আড্ডায় যান না।

প্রয়োজন ছাড়া তেমন কোনো কথা বলেন না কারো সঙ্গে।  নির্ধারিত ফোন নম্বরটি ব্যবহার করছেন না।  যোগাযোগ নেই বন্ধুদের সঙ্গে।  খুব কাছের কেউ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না।  মামলা করার পর থেকেই হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে।  একইভাবে বড় অঙ্কের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয় নির্যাতিতাদের।

গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে সেই ভয়াল রাতের বর্ণনাসহ বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলেছেন তারা।  নির্যাতিতারা জানিয়েছেন, ভয়াল সেই রাতের পরও স্বাভাবিকভাবে দিনাতিপাত করতে চেয়েছিলেন।  কিন্তু ধর্ষকরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দেয়নি তাদের।  মামলা করার পর মামলার বাদীর মায়ের নম্বরে একটা কল আসে।  ইন্টারনেট ব্যবহার করে আসা ওই কলের ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেট নম্বর’ লেখা ছিল।

কলটি রিসিভ করার পর সালাম দিয়ে বাদীর মায়ের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে কথা বলা শুরু করে পুরুষটি।  মামলা তুলে নিতে অনুরোধ করে বলে, যা হওয়ার হয়েছে।  মানুষ জানছে।  আরো জানবে।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে কিছুই হবে না।  কারণ সাফাতের বাবার টাকা আছে।  টাকা দিয়ে সব নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে।  টাকা থাকলে সব কেনা যায়।  কিন্তু বড় ক্ষতি হবে আপনাদের।  মেয়ে বলে কথা।  মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে।  মান-সম্মান বলে কথা আছে।  ওই ছেলেরা একটা ভুল করে ফেলেছে।

তারা মাফ চাইবে।  আর আপনার মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য যা করা দরকার তাই করে দেবে তার বাবা।  এ বিষয়ে সরাসরি দেখা করে কথা বলার প্রস্তাব করে ওই লোকটি।  নির্যাতিত তরুণীর মা তার সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।  বলেন, এ বিষয়ে আমরা কোনো কথা বলতে পারবো না।  দয়া করে আপনি কল দেবেন না।  কিন্তু লোকটি কিছুতেই থামে না।  বলে যায়, শুনুন মামলা করে কি হবে? যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।  জানি এর ক্ষতিপূরণ হয় না।  তবু বলছি আপনারা যা চান, যতো টাকা চান তা দিয়েই সমাধান করা হবে।

মায়ের বরাত দিয়ে ওই তরুণী বলেন, তারপর মা লাইন কেটে দেন।  পরে সাফাত গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক দিন এই নম্বর থেকে কল এসেছে।  মা রিসিভ করেননি।  আর আমি তো অপরিচিত নম্বর খুব কম রিসিভ করি।  আমরা শুধু ওদের পানিশমেন্ট চাই।

আর কিছুই চাই না।  তাই মামলা ওঠানোর প্রশ্নই উঠে না।  মামলা করার পর অনেক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ১৪ই মে সন্ধ্যায় দুই অস্ত্রধারী যুবক বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলো।  গার্ড বাধা দিলে বাকবিতণ্ডা হয়।  হুমকি দেয় তারা।  পরে মোটরসাইকেলযোগে চলে যায়।
২৮শে মার্চ।  সেই ভয়াল রাতে ঘটে ঘটনাটি।  এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নির্যাতিত ওই তরুণী বলেন, হোটেলে গিয়ে অন্য মেয়েদের দেখি।  হোটেলে যাওয়ার পর সেখানকার এনভরমেন্ট ভালো লাগেনি আমাদের।  ওখানে দুটি মেয়ে ছিল।  বারবার দেখছি, এদের নিয়ে একবার সাফাত রুমে যায়।  অনেকক্ষণ থাকে।  এরপর নাঈম যায়।  আমরা রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম।

সেখানে আমরা দুই বান্ধবী কিছু খাইনি।  সাফাতসহ অন্যরা খেয়েছে।  ওরা ড্রিংকস করেছে।  পরে হোটেলের একটি কক্ষে ব্যাগ রেখে সুইমিং পুলে নেমেছিলাম।  সেখানে আমি, আমার বান্ধবী, সাফাতের আরেকটা মেয়েফ্রেন্ড, সাফাত, সাকিফ ও আমার ডাক্তার বন্ধু নেমেছিলো।  সুইমিং পুল থেকে ওঠার পর অন্য মেয়েরা চলে যাচ্ছিলো।  তখন একটা মেয়ে আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো।

 কিন্তু সাফাত কাছে চলে আসায় সে কিছু বলতে পারেনি।  পরে তারা চলে যায়।  এসময় আমার মা কল দেন।  আমরা চলে যেতে চাই।  তখন সাফাতের আসল রূপ প্রকাশ পায়।  আমাদের যেতে দেবে না।  আমাদের ফোন কেড়ে নেয়।  আমার ফ্রেন্ডের কার-এর কিউ সিজ করে রাখে।  আর আমাদের সবাইকে দুটি রুমে আলাদা করে রাখে।  আর ডাক্তার বন্ধুকে বলে যে, ও পালিয়ে যেতে পারবে না।  নিচে গানম্যান আছে।  আর মেইনলি ওদের কাছে পিস্তল ছিল।  যতদূর মনে পড়ে নাঈমের কাছে পিস্তল ছিল।

একই রুমে আমাকে ও আমার বান্ধবীকে জোর করে ধর্ষণ করে সাফাত ও নাঈম।  সেখানে সাকিফ ও বিল্লালও ছিল।  সাফাতের নির্দেশে বিল্লাল ভিডিও করে।  ওরা সে রাতে মানুষ ছিল না।  জানোয়ারকেও আমি তাদের চেয়ে ভালো বলবো, বুঝলেন।  অনেক চিৎকার করেছি।  কেউ আসেনি সেইফ করতে।  ওরা আমাদের বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় বারবার।  যাওয়ার সময় বলেছিলো, যখন ডাকবো তখনই আসবা।  ভিডিও নেটে ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখিয়েছিলো।  ওই রাতে ওরা ইয়াবা সেবন করেছিলো।

সাকিফের সঙ্গে করা কিছু চ্যাটের কপি দেখিয়ে বলেন, কেমন পরিস্থিতি থেকে এসেছি দেখেন।  এই সাকিফ ইচ্ছে করলে পারতো তো বাঁচাতে।  সাকিফ যা করেছে।  তা কোনো বন্ধু করতে পারে না।  তিনি জানান, প্রায় দুই বছর আগে রেগমান গ্রুপের মালিকের ছেলে সাদমান সাকিফের সঙ্গে পরিচয়।  একটা প্রোগ্রামের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে জব খুঁজতে গিয়েই পরিচয়টা হয়।

তারপর বন্ধুতা।  একদিন সন্ধ্যায় কল করে সাকিফ বলে যে, সে মিট করতে চায় আমাদের সঙ্গে।  তখন আমি বললাম, আজ বাদ দাও।  বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।  অন্যদিন দেখা করবো।  কিন্তু সে বললো, আরে আসো।  আমার সঙ্গে এক বড় ভাই (সাফাত) আছে।  তখন আমি বলছি, দেখো আই ডোন্ট লাইক টু মিট আননোন পিপল।  পরে সাকিফ বলে, আরে এসো, সে অনেক ভালো।  হেন তেন ইত্যাদি।

তখন আমি বলেছি, তিনি চলে গেলে বলো।  তখন এসে দেখা করে যাবো।  অনেকবার বলার পর গেছি।  প্রথম দিনই সাফাত তার নিজের কথা বলছিল যে, এক মেয়ের সঙ্গে তার রিলেশন ছিল।  ভেঙে গেছে তার বাবার কারণে।  তারপর খুব আজেবাজে কথা বলতেছিল ওই মেয়েকে নিয়ে।

 তখন আমরা একটু আনইজি ফিল করছিলাম।  এরমধ্যে সাফাত ও সাকিফ আলাদা দূরে গিয়ে কথা বলেছিল।  পরে কাছে বসে সাফাত আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমরা দুজন খুব ভালো।  আজ থেকে তোমরা আমার খুব ভালো ফ্রেন্ড হয়ে গেছো।  তারপরই তার বার্থডে’র কথা বলছিলো।

ইচ্ছাকৃত যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে সাফাতের দাবি প্রসঙ্গে ওই তরুণী বলেন, যদি ইচ্ছেকৃত হতো তাহলে মামলা করলাম কেন।  মামলা করার প্রশ্নই উঠতো না।  ওরা কত লুকাবে আর বানিয়ে বলবে বলতে পারেন? সত্যি তো বের হবেই।  ওরা অনেক মেয়ের জীবনই নষ্ট করেছে।

এ ঘটনার পর বদলে গেছে এই দুই তরুণীর জীবন।  এ বিষয়ে ওই তরুণী বলেন, ক্লাস আর বাসা।  কারও সঙ্গে দেখা করি না।  কোনো রিলেটিভের বাসায় যাই না।  সারাদিন বাসায় থাকি।  কিছুদিন আগে তো ক্লাসে যাচ্ছিলাম না।  মেন্টালি একটু সিক আর আপসেট ছিলাম।  সামনে এক্সাম কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছি না।  একই কথা বলেন, নির্যাতিত অন্য তরুণী।

 তিনি বলেন, আমাদের দুজনেরই একই অবস্থা।  মাথার মধ্যে একটা জিনিস ঘুরে ওদের কি পানিশমেন্ট হবে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাফাতের সঙ্গে নিজের ছবি ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে মামলার বাদী বলেন, ওই ছবি এটা প্রমাণ করে না যে, ওই রাতে তারা জোর করে নির্যাতন করেনি।  সাফাত তো বন্ধু ছিল।  ছবি থাকতেই পারে।  কিন্তু কারা, কি উদ্দেশ্যে ছবি ভাইরাল করছে।  পুলিশ কেন তা দেখছে না- প্রশ্ন করেন তিনি।
নবীনতর পূর্বতন