নেটোতে যোগ দিতে ফিনল্যান্ডের জনগণ কেন আগ্রহী হয়ে উঠছে

 


ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো থেকে শুরু করে মলদোভা পর্যন্ত রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে।

তাত্ত্বিকভাবে হলেও ফিনল্যান্ড নিরাপদ হওয়া উচিত, কারণ এটি ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ একটি দেশ। এছাড়াও ১৯৩৯ সালে স্তালিনের সোভিয়েত সেনাবাহিনী ফিনল্যান্ডে আক্রমণ করলে তার বাহিনীকে বেশ কঠিন সময় পার করতে হয়েছিল।

সুইডেনসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে নেটোর সামরিক জোটে যোগদানের জন্য কখনোই খুব বেশি সমর্থন ছিল না।

কিন্তু যখন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সম্প্রতি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে স্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, নেটোর সদস্য হওয়ার দিকে তাদের যেকোনো পদক্ষেপের পরিণতি হতে পারে সামরিক, তখন উভয় দেশের মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত হয়।

 

তারপর থেকে, রাশিয়ান যুদ্ধবিমান নির্বিচারে সুইডিশ আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করেছে।

নিরপেক্ষ থাকাই যদি রাশিয়ার কাছ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জনগণ বলছে, হয়তো নেটোতে যোগ দিলে দেশ দুটি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পেতে পারে।

এটি তাদের চিন্তাধারায় বেশ বড় একটি পরিবর্তনকেই তুলে ধরে। কারণ মনে করা হয় যে, রাশিয়ার সাথে ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক বেশ ভাল।

কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন সবকিছু বদলে দিয়েছে।

রাশিয়ান সৈন্যরা ইউক্রেনে প্রবেশের কয়েকদিন আগে, আলেক্সি স্যালোনেন এবং সাম্পো মুহোনেন নামে ফিনল্যান্ডের দুই ব্যক্তি রাশিয়ার দিক থেকে ক্রমবর্ধমান হুমকি সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেন এবং বলতে থাকেন যে ফিনল্যান্ডের জন্য নেটো জোটের সদস্য পদের জন্য আবেদন করা নিরাপদ হবে।

তারা অনলাইনে তিন বন্ধুর কাছে ধারণাটি তুলে ধরেন এবং পরে তারা পাঁচজন মিলে বিষয়টি ফিনিশ পার্লামেন্টে তুলতে একটি পিটিশনের জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন।

ফিনল্যান্ডের সংসদে কোন কিছু নিয়ে বিতর্ক শুরু করতে হলে, একটি প্রস্তাবের পক্ষে ৫০ হাজার স্বাক্ষর থাকতে হয়। কিন্তু তারা ১০ দিনের মধ্যে ৭০ হাজার স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে সক্ষম হন।

তারা ফিনিশ জনগণের মধ্যে একটি সাড়া ফেলে দিয়েছেন, এবং এখন বিষয়টি সরকারের সামনে আনা হবে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপ ইঙ্গিত করে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই ধারণাটিকে সমর্থন করছে।

ফিনল্যান্ড বেশ সাবধানী একটি দেশ এবং এর সরকারও বেশ দূরদর্শী। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আন্টি কাইকোনেনের কাছে এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হলে, তিনি উত্তর না দেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে পরিস্থিতি কঠিন। কিন্তু তিনি বলেন যে, নেটোতে যোগদান এমন একটি বিষয় যার জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল বিবেচনার প্রয়োজন।

সম্ভবত ফিনিশ সরকার কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ইউক্রেনে কী ঘটে তা দেখতে চায়। স্পষ্টতই ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে হাত রাঙানোর পর পরই রাশিয়া অন্য কোনো দেশে আক্রমণ করবে না।

ফিনল্যান্ডের দিক থেকে দেখতে গেলে, ইউক্রেন আক্রমণের সাথে ১৯৩৯ সালের ফিনল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে- যা দেশটিতে শীতকালীন যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ জোসেফ স্তালিন তার সেনাবাহিনীকে ফিনল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করতে যে, জেনারেলরা তাকে যে ধারণা দিয়েছিলেন তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা আসলে তার চেয়েও শক্তিশালী। ফিনল্যান্ডের জনগণ তখন বিশাল এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। ওই বাহিনীর মনোবল এক বছর বা তারও আগে গুরুতরভাবে ভেঙে পড়েছিল। ওই বাহিনীর বেশিরভাগ শীর্ষ ব্যক্তিত্বের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে।

আলোচনা শুরু হওয়া এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আগে 'শীতকালীন যুদ্ধ' কয়েক মাস ধরে চলেছিল। সেসময় রাশিয়া ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। কিন্তু ফিনরা তাদের স্বাধীনতা হারায়নি- এবং তখন থেকে তারা এটি এখনো ধরে রেখেছে।

ইউক্রেনের আগ্রাসনও একইরকম বিশৃঙ্খলভাবেই পরিচালিত হয়েছে। রসদগত দিকটি শুরু থেকেই গোলযোগপূর্ণ। সৈন্যদের জন্য খুব কম জ্বালানি, খাদ্য এবং পানীয় জল সরবরাহ করা হয়েছে। সেনাদের মধ্যে অনেককে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে তারা কেবল একটি মহড়ায় অংশ নিচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনকি সেনাদের যথাযথভাবে মানচিত্রও সরবরাহ করা হয়নি। ট্যাঙ্ক চালকদের প্রায়ই দিকনির্দেশ পেতে থামতে হয়েছে। এটি কোনওভাবেই ঝটিকা অভিযান ছিল না, এবং আধুনিক যুদ্ধের যেটি পূর্বশর্ত অর্থাৎ- শত্রুপক্ষের যোগাযোগের ধ্বংস করা- সেটিও কখনও করা হয়নি।

তার মানে এই নয় যে, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শেষ পর্যন্ত জিতবেন না।

তিনি ইতিমধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তিনি পুরো ইউক্রেন দখল না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। বিপদ হল, তিনি যদি তার প্রচলিত বাহিনী দিয়ে এটি করতে না পারেন তবে ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য তার কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার প্রলোভন বাড়বে।

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা এর সম্ভাবনা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। সেই সীমা অতিক্রম করা হলে কোন নিশ্চয়তা থাকবে না।

রাশিয়া দাবি করেছে যে, তারা ইউক্রেন আক্রমণ করেছে কারণ তারা ইউক্রেনের জনগণকে নব্য-ফ্যাসিবাদ থেকে বাঁচাতে চায়। প্রেসিডেন্ট পুতিন সত্যিকার অর্থে যা নিশ্চিত করতে চান তা হলো, রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেনের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নেয়া এবং একই সাথে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির নেটোতে যোগদানের বিষয়টি ঠেকানো।

প্রকৃতপক্ষে, এটি অদূর ভবিষ্যতের মধ্যে এর সম্ভাবনা ছিল বলে মনে হয় না।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি বাস্তব বিড়ম্বনা হচ্ছে- ইউক্রেনের যুদ্ধ এখন ফিনল্যান্ড এবং সম্ভবত সুইডেনকেও তাদের পশ্চিমা সামরিক জোটে যোগদান করা উচিত কি না তা বিবেচনা করার জন্য তাদেরকে একটি প্রকৃত কারণ দিয়েছে।

 

 

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন