October 13, 2025
Screenshot 2025-03-19 215912

ধর্ষণের মামলার বিচারকাজে তাড়াহুড়া করে আইন সংশোধন না করে আলোচনা করার তাগিদ দিয়েছেন আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং অধিকারকর্মীরা। আজ বুধবার ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট’ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বক্তারা বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার প্রতিষ্ঠায় আইনের কোথায় কতটুকু সংশোধনের প্রয়োজন, তা আলোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা উচিত। কঠোর শাস্তি বিচারের নিশ্চয়তা আনে না। অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি দিতে হবে। তাঁরা ধর্ষণের সংজ্ঞাতেও সংশোধন আনার দাবি জানান।

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘ধর্ষণ ও নির্যাতন: আইনগত সুরক্ষায় করণীয়’ শিরোনামে সভার আয়োজন করা হয়।

মাগুরার শিশুটির ঘটনা ঘিরে সারা দেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ–সমাবেশের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। এতে ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে আনা হচ্ছে। আর শিশু ধর্ষণের মামলার বিচার আলাদাভাবে করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বিধান রাখা হচ্ছে। ডিএনএ পরীক্ষার সনদ ছাড়াই আদালত যদি মনে করেন চিকিৎসা সনদ ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার সম্ভব, তাহলে আদালত ডিএনএ সনদ ছাড়াই বিচার করতে পারবেন।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ২০১৮ সালে ১৫টি সংগঠনের অংশগ্রহণে ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট তৈরি করা হয়। জোটের সচিবালয় হচ্ছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)। সভায় বলা হয়, ধর্ষণের ধারায় সংশোধন আনতে এই জোটটি দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করলেও আইন সংশোধনের সময় জোটের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। নারী ও শিশুর পরিবর্তে ‘ব্যক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করে ধর্ষণের সংজ্ঞা বৈষম্যহীন করার দাবি ওঠে মুক্ত আলোচনায়। নারী ও মেয়েশিশুর মতো পুরুষ, ছেলেশিশু, হিজড়া ও অন্যান্য লিঙ্গের ব্যক্তিদের অসম্মতিতে যৌনসংগমকে ধর্ষণ বলে গণ্য করতে বলা হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন, ভুক্তভোগীর চরিত্রগত সাক্ষ্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, ভুক্তভোগীর জন্য রাষ্ট্র পরিচালিত ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনসহ ১০টি সুপারিশ করা হয়।

মতবিনিময় সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, ‘একটা ঘটনা ঘটলে আমরা তড়িঘড়ি করে আইন সংশোধন করতে বসে পড়ি। এই মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। সরকারকে আমি ধন্যবাদ দেব, যদি তারা নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার প্রতিষ্ঠায় তাড়াহুড়ো না করে আইনের কোথায় কতটুকু সংশোধনের প্রয়োজন, তা আলোচনার ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা উচিত। বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলে এত আইনের প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন, ‘একটি ছেলে কেন ধর্ষণ করছে, সে দায়ও সমাজের সবার। কারণ, ছেলেটিকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। সন্ধ্যার পর আমরা মেয়েকে বাইরে যেতে দিই না। অথচ বাইরে কি কুকুরে কামড়ায় নাকি সাপ তাড়া করে?’

সভায় আলোচক হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির উপদেষ্টা সালমা আলী বলেন, ধর্ষণের মামলায় ভারত ও নেপালে কিছু ভালো রায় হয়েছে। সেসব দেখে আইন সংশোধন চূড়ান্ত করার আগে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে ধর্ষণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মতামত নেওয়া উচিত। ধর্ষণের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকারের সদিচ্ছাই বড় বিষয়। তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে যেন অপরাধের মাত্রা কমে আসে। থানায় ও আদালতে ভুক্তভোগীর প্রতি আরও সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে। সংবাদমাধ্যমকেও সতর্ক থাকা উচিত, যেন সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে ভুক্তভোগীকে হয়রানি না করা হয়।

অপর আলোচক নারীপক্ষের সদস্য ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহীন সুলতান বলেন, ধর্ষণের মতো অপরাধ শুধু আইন দিয়ে থামানো যাবে না। মাগুরার শিশুর ঘটনাটি সবাইকে নাড়া দিয়েছে। মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে। ত্বরিত গতিতে আইন সংশোধন করার ক্ষেত্রে সবার মতামত নেওয়া হয়েছে কি না, সেটা দেখা দরকার। ধর্ষণ আইন সংস্কার জোটকে ডাকা হয়নি। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের মতামতও চাওয়া হয়নি। কেন তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে না, তা ঠিক না করে আইন সংশোধন করে লাভ হবে না। তিনি বলেন, সংশোধনে আরও সময় নেওয়া উচিত। এটা জাতীয় বিষয়, কাউকে দেখানোর বিষয় নয়। দণ্ড বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। সাজা বাড়ালে রায়ের হার কমে যায়। কঠোর শাস্তি বিচারের নিশ্চয়তা আনে না। অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি দিতে হবে।

সভায় সভাপতিত্ব ও সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা। তিনি আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে বলেন, দণ্ডবিধি থেকে ধর্ষণের সংজ্ঞা নেওয়া হয়েছে। সেখানে পরিবর্তন আনা দরকার। সাক্ষীকে সুরক্ষা দেওয়া, সময়মতো তদন্ত করা এবং দ্রুত বিচারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাগত বক্তব্য দেন ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম।

সভায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়াবিষয়ক সুপারিশমালা তুলে ধরেন ব্লাস্টের আইনি বিশেষজ্ঞ আয়েশা আক্তার এবং জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা ফাহাদ বিন সিদ্দিক।

সভায় ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণকে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষের অপরাধ হিসেবে ধরে পাঁচটি বিষয়ের ওপর ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। বতর্মান আইন ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ ভুক্তভোগীর বয়স ও বৈবাহিক ধর্ষণ ছাড়া ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধিতে দেওয়া ধর্ষণের সংজ্ঞাই অনুসরণ করে। দণ্ডবিধিতে ধর্ষণ হয়েছে কি না, তা পেনিট্রেশন (অভ্যন্তরে প্রবেশ) থেকে বোঝার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ প্রবেশের মাধ্যমে যৌনসংগমের কথা বলা হয়েছে।

সভায় জোটের প্রস্তাবে ধর্ষণের সংজ্ঞায় সংশোধন আনার প্রস্তাব করা হয়। এতে বলা হয়, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌনসংগমের অভিপ্রায়ে তার সম্মতি ব্যতিরেকে বা বলপূর্বক আঘাত করে, ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণামূলক সম্মতি আদায় করে ইচ্ছাপূর্বক লিঙ্গ (পেনিস) বা অন্য কোনো বস্তু অন্য ব্যক্তির মুখ বা পায়ুপথে বা যোনিপথে প্রবেশ করিয়ে যৌনসংগম করে, তাহলে সেটাকে ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *