October 13, 2025
Screenshot 2025-04-01 222829

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার নারিকেলবাড়িয়া এলাকার গৃহবধূ স্বরভানু বেগম (৫৫)। পা পিছলে পড়ে গিয়ে বাঁ হাতে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি চিকিৎসা নিতে মেয়ে ও জামাতার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার রাজাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। জরুরি বিভাগে তাঁকে এক্স–রে করতে বলা হয়েছিল। টেকনোলজিস্ট না থাকায় হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনটি ১০ বছর ধরে বন্ধ। ১৫০ টাকা সরকারি খরচের এক্স-রে তাঁকে বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ৩৫০ টাকায় করতে হয়েছে। পরে হাসপাতালে এসে তিনি ভাঙা হাতের ব্যান্ডেজ করেন।

রাজাপুরে বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক হাটের দিন থাকায় অন্যান্য দিনের তুলনায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর চাপ অনেক বেশি ছিল। সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের টিকিট কাউন্টারে রোগীদের দীর্ঘ লাইন। কাউন্টারের টিকেট বিক্রেতা রোগের ধরন অনুযায়ী রোগীদের বিভিন্ন কক্ষে চিকিৎসকদের কাছে পাঠাচ্ছেন।

জরুরি বিভাগ সামলাচ্ছেন নাজনিন সুলতানা নামের একজন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা। তিনি রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাপত্র দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ বলছে, চিকিৎসক–সংকটের কারণে কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ে জরুরি বিভাগের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। চিকিৎসকদের ২৭টি পদের মধ্যে ১৭টি পদই শূন্য। সিনিয়র কনসালট্যান্ট আছেন মাত্র দুজন। গাইনি বিভাগের একজনমাত্র জুনিয়র কনসালট্যান্ট অন্তঃসত্ত্বা নারীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।

ভবনের প্রধান ফটকের সামনেই এক নারী কর্মী হাসপাতালের ফার্মেসিতে বসেছেন। চিকিৎসকেরা রোগীদের যে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, তার কিছু অংশ তিনি বিতরণ করছেন। আর যে ধরনের ওষুধ হাসপতালের তালিকায় নেই, তা বাইরে থেকে কিনতে পরামর্শ দিচ্ছেন।

সকাল থেকে ভবনের দ্বিতীয় তলায় চিকিৎসককে দেখানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন অন্তত ২৫ জন অন্তঃসত্ত্বা। বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সেখানে কথা হয় উপজেলার চর হাইলাকাঠি গ্রামের শান্তা আক্তারের (১৯) সঙ্গে। তিনি সকাল নয়টা থেকে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী যদি আড়াই ঘণ্টা ধরে একজন চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন, তাহলে তাঁর শরীরের কী অবস্থা দাঁড়ায়!

সকাল থেকে বহির্বিভাগে চার শতাধিক রোগী অবস্থান করছিলেন। তিনজন চিকিৎসক উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের মাহামুদ, চিকিৎসা কর্মকর্তা তমাল হালদার এবং আয়ুর্বেদিক ও ন্যাচারাল মেডিসিন শাখার মো. হাসিবুল হোসাইন চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।

হাসপাতাল ভবনের দ্বিতীয় তলায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অপেক্ষা
হাসপাতাল ভবনের দ্বিতীয় তলায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অপেক্ষাছবি: প্রথম আলো
নিচতলার একটি কক্ষে বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষার কাজ করছিলেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হাসান হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে তিনি এখানে যোগ দেন। এর আগে এই হাসপাতালে তেমন কোনো পরীক্ষা–নিরীক্ষা হতো না। এখনো কিছু রাসায়নিক পদার্থের অভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রক্তের পরীক্ষা হয় না। রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা পরিমাপ করার জন্য রোগীদের লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা বাইরে থেকে করতে হয়। মেডিকেল টেকনোলজিস্টের চারটি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র একজন। তিনি ঈদের ছুটিতে ৯ দিন বাড়িতে থাকবেন। এই ৯ দিন হাসপাতালে সব ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা বন্ধ থাকবে।

হাসপাতালের নারী, শিশু ও পুরুষ ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রোগী ভর্তি আছেন ৬৫ জন। জরুরি বিভাগে নতুন করে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করছেন আরও চার-পাঁচজন। তবে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ড পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন দেখা গেল। বিশেষ করে শৌচাগার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিদিন দুবার পরিষ্কার করেন। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের মাহামুদ ও চিকিৎসা কর্মকর্তা তমাল হালদার প্রতিদিন দুবার হাসপাতালের ওয়ার্ড প্রদর্শন করেন।

হাসপাতালের নিচতলার বহির্বিভাগে আবুল খায়ের মাহামুদের কক্ষের সামনে রোগীদের ভিড় দেখা গেল বেশি। তিনি হাসপাতালে রোগীদের চাপ সামলান বেশি। আবার প্রশাসনিক কাজও সামলাতে হয় তাঁকে। তিনি বলেন, ‘চিকিৎসক–সংকটের কারণে রোগীর চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। যতটুকু সম্ভব এর মধ্যেই রোগীদের ভালো সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি।’

হাসপাতালের নিচতলায় ডায়াবেটিক রোগীদের আলাদা কর্নার আছে। এখানে রোগীদের জন্য হাসপাতাল থেকে ইনসুলিনসহ ডায়াবেটিসের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদের সন্তুষ্টির কথা জানা গেল।

দুপুরের দিকে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখা গেল অসুস্থ এক শিশুকে কোলে নিয়ে একজন বাবা জরুরি বিভাগের দিকে ছুটছেন। শিশুটির কান্না থামছে না। শিশুর মাকেও কান্না করতে দেখা গেল। তার কী হলো, শেষ পর্যন্ত আর দেখা হয়নি। এখানে চিকিৎসা থাকলে সেবা পাবে, নইলে উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে বরিশালে পাঠানো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *