বিষয়টি শুনলেই মনে হয় আমরা যেন সভ্যতার গন্ডি পেরিয়ে এক অচেনা অন্ধকারে পা রেখেছি। প্রশাসনিক দাবি-দাওয়া, রাজনৈতিক আন্দোলন—সবই এই সমাজে ছিল এবং আছে। মানুষ তাদের অধিকার আদায়ে পথে নামে, মানববন্ধন করে, মিছিল করে, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করে দাবি আদায়? একটি রেলগাড়ির জানালা বা দরজার ওপারে যে মানুষগুলো বসে থাকে, তারা কারো বাবা-মা, সন্তান, শিক্ষার্থী, শ্রমিক—একজন সাধারণ যাত্রী। তাদের চোখ-মুখে আতঙ্ক আর ভয় ছড়িয়ে দিয়ে একটি অঞ্চলকে জেলা ঘোষণার দাবি—এ যেনো সভ্য সমাজের অসভ্যতম আচরণ।
এ ঘটনাকে শুধু অপরাধ বলে পার পাওয়া যায় না, এটি রাষ্ট্রের গণপরিবহন ব্যবস্থার ওপর এক নৃশংস আঘাত। বাংলাদেশে রেলপথ এখনো এক শ্রেণির মানুষের প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম। নিরাপদ ভ্রমণের স্বপ্ন নিয়ে তারা ট্রেনে ওঠেন। আর সেই ট্রেনই যদি আতঙ্কের বাহন হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় দাঁড়াবে? রাষ্ট্রীয় সম্পদে হামলা কোনোভাবেই দাবি আদায়ের ভাষা হতে পারে না।
সমস্যা হলো—আমাদের সমাজে এখন আন্দোলনের সংজ্ঞা বিকৃত হয়ে গেছে। যে যার মতো করে যেকোনো দাবি তুলে ধরা, এবং সেই দাবির জোর প্রমাণ করতে সহিংসতায় নেমে যাওয়া এক অদ্ভুত নৈতিক অধিকার বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আন্দোলনের প্রধান ভিত্তি জনমত, যুক্তি, প্রমাণ ও শৃঙ্খলা। এখানে হিংসা নয়, যুক্তির শক্তিই প্রাধান্য পায়। কিন্তু আমরা সেই প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে শর্টকাট পথ বেছে নিচ্ছি—অরাজকতা সৃষ্টি করো, ভয় দেখাও, প্রচার পেয়ে যাবে। এই অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্রমেই সমাজকে বিপন্ন করে তুলছে।
চলন্ত ট্রেনে পাথর মেরে যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা মানে শুধুমাত্র সম্পত্তি নষ্ট করা নয়, এটি খুনের চেষ্টা। অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন, শিশুরা রক্তাক্ত হয়েছে—এই দায় কার? কে নেবে? এমন একটি অন্যায়কে যারা নীরবে সমর্থন করে বা তুচ্ছ বলে এড়িয়ে যায়, তারাও এই সমাজিক অপরাধচক্রের অংশ হয়ে যাচ্ছে।
এখানে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে—ভৈরবকে জেলা ঘোষণার দাবি কি অযৌক্তিক? হয়তো যুক্তিযুক্ত। মানুষের চাওয়া থাকবে, সেখানে কোনো ভুল নেই। জেলা হওয়ার পেছনে উন্নয়ন, সামাজিক কাঠামো, প্রশাসনিক সুবিধা—এসবই থাকে। কিন্তু সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার পথ যদি হয় ধ্বংস-জখং, তাহলে তা দাবি নয়, জবরদস্তি। দাবির নৈতিক শক্তি তখনই থাকে যখন তা গণসমর্থন, যুক্তির আলো এবং শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে তুলে ধরা হয়।
আমাদের সমাজে একটি বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়েছে—গণতান্ত্রিক সুযোগের অপব্যবহার। রাষ্ট্র যদি কোনো দাবি তৎক্ষণাৎ পূরণ না করে, তাহলে আমরা ধরে নিই আমাদের দাবি অস্বীকার করা হলো, তাই আমরা রাস্তায় নেমে ধ্বংসযজ্ঞ তৈরি করি। অথচ যে রাষ্ট্র আমাদের সেবা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে, সেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকেই অচল করে দেওয়ায় আমরা কেউ লাভবান হই না। বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি, সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রা আর নিরাপত্তা।
চলন্ত ট্রেনে হামলার ঘটনাগুলো নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে এমন অপরাধ বেড়েই চলেছে। কখনো কিশোরদের বিনোদন, কখনো চুরি, আবার কখনো রাজনৈতিক বা স্থানীয় দাবি—সবকিছুর আড়ালে একটি ভয়ানক সত্য রয়েছে—আমরা শৃঙ্খলাবোধ হারাচ্ছি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—সবারই দায়িত্ব মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া। অথচ সেই জায়গাতেই শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যে তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ হওয়ার কথা, তারা আজ ভয়, আতঙ্ক ও ধ্বংসের কারিগর হয়ে যাচ্ছে।
আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এমন অপরাধ ঠেকানো সম্ভব নয়। যারা সরাসরি পাথর নিক্ষেপ করছে, তাদের গ্রেপ্তার করলেই হবে না; যারা উসকানি দিচ্ছে, যাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশে এসব করা হচ্ছে—তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে একটি বড় কাজ হলো—জনসচেতনতা গড়ে তোলা। ট্রেনে হামলা মানে মানুষের জীবনকে লক্ষ্যবস্তু বানানো। এটি কোনো এলাকার দাবি না; এটি সন্ত্রাস।
আজ যখন আমরা ভৈরবকে জেলা ঘোষণার দাবি দেখি, তখন মনে হয়—মানুষের স্বপ্নগুলোও যেন হিংসাত্মক আকার নিচ্ছে। উন্নয়ন মানে কি ধ্বংস? অগ্রগতি মানে কি আতঙ্ক ছড়িয়ে দাবি আদায়? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কোন পথে হাঁটছি? সভ্যতার পথ অবশ্যই এটি নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে—একটি অঞ্চল তখনই উন্নত হয়, যখন তার মানুষ উন্নত চিন্তা ও সংস্কৃতি ধারণ করে। জেলা হওয়া মানে শুধু প্রশাসনিক মানচিত্রে একটি নতুন নাম যোগ হওয়া নয়; এর গভীরতর অর্থ আছে—সুশাসন, শিক্ষার উন্নয়ন, অবকাঠামো, শিল্পায়ন, প্রশাসনিক সুবিধা, দক্ষ জনশক্তি। এগুলোর জন্য সময়, পরিকল্পনা ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কিন্তু যারা আজ পাথর হাতে ট্রেন আক্রমণ করছে তারা কোনো উন্নয়ন চায় না—তারা শুধু শিরোনাম চায়, নিজেদের অবস্থান দেখাতে চায়। অথচ এ ধরনের আচরণে সরকারও তাদের দাবি বিবেচনায় নিতে সংকোচবোধ করে। কারণ নৈতিক ভিত্তি ভেঙে গেলে দাবি শক্তি হারায়।
আমাদের এই সমাজে এখন সবচেয়ে প্রয়োজন আচরণগত পরিবর্তন। দাবির ভাষা হোক যুক্তি ও দাবির পথ হোক শান্তিপূর্ণ। শুধু ভৈরব নয়—পুরো বাংলাদেশেই প্রতিটি দাবিদাওয়া হোক নিয়মতান্ত্রিক ও সভ্য উপায়ে। কারণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে, জনগণেরও দায়িত্ব আছে। উভয় পক্ষ যখন পরস্পরের মর্যাদা রক্ষা করে, তখনই একটি রাষ্ট্র এগিয়ে যেতে পারে।
আমরা একটি স্বাধীন দেশ। সংগ্রাম করে, রক্ত দিয়ে, আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই দেশ পেয়েছি। এই দেশটির গাড়ি-বাস-রেল, সেতু-সড়ক—সবই আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলো ধ্বংস করে আমরা কার ক্ষতি করি? নিজেদেরই।
আজ তাই সময় এসেছে দৃঢ়ভাবে বলার—
ট্রেনে পাথর মেরে জেলা নয়, কেবল লজ্জাই পাওয়া যায়।
সভ্য সমাজে অসভ্য আচরণের জায়গা নেই। উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে গেলে প্রয়োজন সঠিক মনোভাব, দায়িত্বশীলতা ও পরিপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ভৈরবের মানুষও নিশ্চয়ই শান্তি, অগ্রগতি ও মর্যাদার স্বপ্ন দেখে—ধ্বংসের নয়। তাদের দাবিতে শক্তি আসুক যুক্তির মাধ্যমে, সহিংসতার মাধ্যমে নয়।
রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে, সমাজকে সচেতন হতে হবে, এবং মানুষকে মানবতার মূল্য বুঝতে হবে। তাহলেই আমরা একটি সুন্দর ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে পারব—যেখানে ট্রেনে পাথর নয়, হাসি থাকবে; ভয়ের বদলে থাকবে শান্তি; আর দাবি হবে যুক্তির আলোয়, সভ্যতার পথ ধরে।
আবুল কালাম আজাদ
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ও কলামিষ্ট
