November 3, 2025
2

স্বাধীনতাবিরোধীরা একাত্তরকে ভুলিয়ে জুলাই আন্দোলনকে বড় করে দেখাতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত ‘স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। সভায় সারাদেশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নেন।

এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ কেবল কিছু উপদেষ্টার সুবিধার জন্য। ফখরুল বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তারাই এখন মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যকে খাটো করছে। আমরা আমাদের নেতা জিয়াউর রহমানের ঘোষণায় ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন- সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছি তারা তা অস্বীকার করতে চায়। আমরা এ ব্যাপারে খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, ১৯৭১ সালকে ভুলিয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। কারণ, ১৯৭১ সাল হচ্ছে আমাদের জন্মের ঠিকানা। আমরা এই দেশ, এই ভূখ-কে একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছি, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে সব সময়।

ফখরুল বলেন, ১৯৭১ হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের কথা, আমাদের পরিচিতির কথা, আমাদের স্বাতন্ত্রের কথা। স্বাধীনতার ঘোষণা হচ্ছে আমাদের একটা নতুন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের কথা। কিন্তু আজকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অনেক অনেক বেশি উলম্ফন দেখতে পাই আমরা। আমি বলব, একবার স্মরণ করুন অতীতের কথা, তবে আমি কারও নাম ধরে বলব না, নিজেদের অতীতটা স্মরণ করবেন। ১৯৭১ সালে আপনাদের কি ভূমিকা ছিল সেটা আপনারা মনে রাখবেন।

স্বাধীনতাবিরোধীদের উদ্দেশ করে ফখরুল বলেন, আমি কথাটা পরিষ্কার করে বলতে চাই, তাতে আপনারা নাখোশ হলে আমার কিছু করার নেই। সেদিন আপনারা মুক্তিযুদ্ধকে গোলমাল বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, কিছু দুষ্কৃকিারী একটা অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করেছে বলে তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে যারা আমাদের হত্যা করছিল তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আপনারা এই দেশের মানুষ হত্যা করেছিলেন এবং আমাদের বহু গুনী-জ্ঞানী ব্যক্তিকে সেদিন হত্যা করে বধ্যভূমিতে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন, আমরা তা এখনো ভুলিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকের অনুষ্ঠানে আগত আপনারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। আপনাদের জন্যই দেশ টিকে আছে। আপনাদের যুদ্ধ ছিল এই দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য। এই দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের-আমাদের সবার। আজকে যে সমস্ত শত্রু দেশকে ধ্বংস করার জন্য, দেশের মানুষকে বিব্রত করার জন্য বিভিন্ন চক্রান্ত করার চেষ্টা করছে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সকল চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেব, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব।

ফখরুল বলেন, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে, ৭ নভেম্বরের পরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংস্কার শুরু করেছিলেন। প্রথমে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদীয় শাসন ব্যবস্থা এবং সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। এই যে এতগুলো পত্র-পত্রিকা, এতগুলো মিডিয়া, এত টেলিভিশন দেখছেন তাদের অতীত কি আপনারা জানেন? শেখ মুজিবুর রহমান সমস্ত পত্রিকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, মাত্র চারটা পত্রিকা রেখেছিলেন, সেই চারটা পত্রিকা সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ফখরুল বলেন, জিয়াউর রহমান দেশের মানুষকে একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, একটা নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এবং তার জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর বেগম খালেদা জিয়া সংস্কারের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছিলেন। তিনি দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন।

জুলাই সনদ প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, এই যে সনদ আমরা পাস করেছি আপনাদের সবার হয়তো মনে আছে সংসদের সামনে বৃষ্টিতে ছাতা ধরে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেছি। ওইখানে আমরা যে বিষয়গুলোতে সই করেছি সেখানে বলা হয়েছিল যেসব রাজনৈতিক দল যেগুলোতে একমত সেগুলো সব সই হয়ে গেল। এমনকি যে সমস্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে না, তারা আপত্তি দেবে সেটাকে বলা হয় নোট অব ডিসেন্ট। সেই নোট অব ডিসেন্ট লিপিবদ্ধ করা হবে এবং সেটা সনদে লেখা হবে, সঙ্গে সঙ্গে লেখা হবে। আর এখন উনারা যেটা প্রস্তাব উত্থাপন করলেন প্রধান উপদেষ্টার কাছে সেখানে ওই নোটের কোনো কথাই নাই, আমাদের এই কথাগুলো বেমালুম ভুলে গেছেন। তারা আবার নতুন করে কিছু বিষয় নিয়ে এসেছেন। এটা অন্যায়, এটা জনগণের সঙ্গে একটা নিঃসন্দেহে প্রতারণামূলক কাজ।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটা দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা একটা প্রেস কনফারেন্স করে কথা বলেছি, আমরা রাস্তায় নামিনি, আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো প্রতিবাদ করিনি, আমরা প্রধান উপদেষ্টার বাড়ি ঘেরাও করিনি বা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করিনি। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল একটা জোট বানিয়ে কর্মসূচি পালন করছে। তারা বিভিন্নভাবে এই সরকারকে বাধ্য করতে চায় যে, তাদের কথাটাই শুনতে হবে। কিন্তু আমাদের কথা খুব পরিষ্কার আমরা যেটা স্বাক্ষর করেছি সেটার অবশ্যই আমরা দায়দায়িত্ব গ্রহণ করব। তবে যেটা আমরা স্বাক্ষর করিনি সেটার দায়দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করব না। আমরা চাই এই বিষয়গুলো একটু আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হোক।

ফখরুল বলেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে একটি দল মিথ্যা কথা বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা বলছে, বিএনপি নাকি নির্বাচন পেছাতে চায়। বাস্তবে নির্বাচন পেছানোর কথা তারাই বলছে। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। আমরা তো গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নির্বাচনের কথা বলে আসছি। আমরা তো নির্বাচন পেছানোর কথা একবারও বলিনি। আমরা বারবার বলেছি যে, নির্বাচনটা অতি দ্রুত করতে হবে। তাদের উদ্দেশে আমি বলব, এসব মিথ্যা কথা বলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করবেন না, মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না।

একটি রাজনৈতিক দলের একজন সিনিয়র নেতার বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, পত্রিকায় দেখলাম আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় একজন বন্ধু মানুষ নিজের এলাকায় আমাদের দোষারোপ করেছেন, আমরা নাকি নির্বাচনকে বাধা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনকে যতটা বাধা সৃষ্টি করেছেন সেটা আপনারা করেছেন। আপনারা পিআরের দাবি নিয়ে এসেছেন, যেটা আলোচনায় ছিল না, জোট পাকিয়ে রাস্তার মধ্যে আন্দোলন করছেন এবং ধমক দিচ্ছেন। মানুষকে বোকা ভাববেন না আপনারা। তাদের একাত্তরের কর্মকা- স্মরণ করার কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

ফখরুল বলেন, আজকে ভারতে বসে শেখ হাসিনা বিভিন্ন মিডিয়াকে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। একবারের জন্যও তিনি অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। তাকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিল ক্ষমা চাইবেন কি না অতীত কর্মকা-ের জন্য। তিনি বলেছেন, না আমরা ক্ষমা চাইব না। সেই মহিলা আজকে অপপ্রচার চালাচ্ছেন ভারতে বসে। ভারত সরকারকে খুব পরিষ্কার করে আমরা বলতে চাই, শেখ হাসিনাকে আপনারা বাংলাদেশে ফেরত দিন এবং বাংলাদেশের আইনে যে বিচারের মুখোমুখি তাকে হতে হবে সেই বিচারের মুখোমুখি করার ব্যবস্থা করে দিন। সব সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করবেন না, মানুষের বিরোধিতা করবেন না, বাংলাদেশের মানুষ সেটা মেনে নেবে না।

ফখরুল বলেন, আমরা এখন অত্যন্ত কঠিন একটা সময় আমরা পার হচ্ছি। এই সময়টা আমাদের জন্য একটা পরীক্ষা। আমরা যেন ধৈর্য ধরে এই সময়টা পার করতে পারি, নির্বাচনটা করতে পারি। তবে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলছিলেন, যে কোনো সময় হামলা হতে পারে। উনার পরিষ্কার করে বলা উচিত ছিল হামলা কোত্থেকে আসবে, কারা করবে। তবে জাতি প্রস্তুত আছে হামলা প্রতিরোধ করতে। এই কথাগুলো আমরা এজন্য বলছি যে, ভয় দেখিয়ে এই দেশের মানুষকে কখনো পরাজিত করা যায় না। খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই এই দেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চায়।

ফখরুল বলেন, একাত্তর সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা যারা করেছিল তারা এখন একাত্তরকে নিচে নামিয়ে দিতে চায়, তারা শুধু ‘২৪’র জুলাইয়ের যে আন্দোলন তাকে বড় করে দেখাতে চায়। আমরা ২০২৪-এর যে আন্দোলন সেটা ১৫ বছর ধরে করেছি, আমরা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, শেখ হাসিনাকে উৎখাতের জন্য ১৫ বছর সংগ্রাম করেছি। এখন আমরা এতে বিভক্তি আনতে চাই না। কিন্তু অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কিছু শক্তি, কিছু মানুষ এখানে বিভক্তি আনতে চায়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উদ্দেশ করে ফখরুল বলেন, নির্বাচন করার যে প্রস্তাব করেছেন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তখনই নির্বাচন হতে হবে। পিআর হবে কি হবে না সেটা আগামী সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে। আপনারা গণভোটের কথা বলেছেন, আমরা রাজি হয়েছি, ঠিক আছে। গণভোটের প্রয়োজন ছিল না। তারপরও রাজি হয়েছি। আমরা বলেছি যে, নির্বাচনের দিনই গণভোট করতে হবে। কারণ, আলাদাভাবে গণভোট করতে হলে খরচ বেড়ে যাবে। প্রায় হাজার কোটি টাকার ওপরে সেই খরচ হবে। তাই আমরা একই দিনে গণভোট ও সংসদ নির্বাচন করতে বলছি। নির্বাচনে ২টি ব্যালট থাকবে, এর মধ্যে একটি ব্যালট গণভোটের, আরেকটি ব্যালট সংসদ নির্বাচনের। এখন কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে গণভোট আগে হবে, তারপরে সংসদ নির্বাচন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ কেবল কিছু উপদেষ্টার সুবিধার জন্য। জুলাই সনদ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আমি একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে মনে করি, দেশের জনগণের এর কোনো প্রয়োজন নেই। এটি কেবল কিছু ব্যক্তি ও কিছু উপদেষ্টা প্রয়োজনে যারা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চান।

মেজর হাফিজ বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার চেষ্টা চলছে। এর কারণ হলো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং যারা এখন সমাজের প্রভাবশালী অংশে আছেন তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি; বরং কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধেও ছিলেন। তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে চায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ জানে ১৯৭১ সালে কারা এই দেশ সৃষ্টি করেছে।

মেজর হাফিজ বলেন, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে মাফিয়া সরকারকে বিদায় দিয়েছি। এখন কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ক্ষমতার লোভে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি তাদের বলব যে, আমরা যারা একসঙ্গে সংগ্রাম করেছি, ঐক্য বজায় রাখুন, ক্ষমতার লোভে যেন জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন না দিই।

মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাতের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, নজমুল হক নান্নু, দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, নির্বাহী কমিটির মিজানুর রহমান, রিটা রহমান ও বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃবৃন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *