December 14, 2025, 6:24 am

‘ব্রেন ডেথ’ কী, এটা থেকে কখনো সেরে ওঠা যায়?

Reporter Name
  • Update Time : Sunday, December 14, 2025
  • 15 Time View

‘ব্রেন ডেথ’ বা মস্তিষ্কমৃত্যু শব্দটি অনেকের কাছেই বিভ্রান্তিকর। কারণ বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে, রোগী এখনো শ্বাস নিচ্ছেন, হৃদ্‌স্পন্দন চলছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, ব্রেন ডেথ মানেই মৃত্যু। এটি একই সঙ্গে একটি চিকিৎসাগত ও আইনগত পরিভাষা।

ব্রেন ডেথ বলতে কী বোঝায়

ব্রেন ডেথ ঘটে তখনই, যখন আঘাত বা রোগের কারণে মানুষের সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক এবং ব্রেনস্টেম স্থায়ীভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ব্রেনস্টেম শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাস ও হৃদ্‌স্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। আর মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করে দেখা, শোনা, স্পর্শ অনুভব করা এবং নড়াচড়ার মতো মৌলিক ক্ষমতাগুলো।

এই সব কাজ বন্ধ হয়ে গেলে চিকিৎসা ও আইনের দৃষ্টিতে সেই ব্যক্তি মৃত হিসেবে গণ্য হন। তাই চিকিৎসকেরা নির্দিষ্ট ও কঠোর চিকিৎসা নির্দেশিকা অনুসরণ করেই ব্রেন ডেথ নির্ণয় করেন। ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার আগে সম্ভাব্য সব বিকল্প কারণ বাতিল করা হয় এবং একাধিক পরীক্ষা করা হয়।

ব্রেন ডেথ কি খুব সাধারণ ঘটনা?

না। ব্রেন ডেথ খুবই বিরল। এক গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের হাসপাতালে মৃত্যুর মোট ঘটনার মাত্র ২ শতাংশ ব্রেন ডেথের কারণে ঘটে।

ব্রেন ডেথের প্রধান কারণ কী

মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে রক্ত ও অক্সিজেনের ওপর নির্ভরশীল। তাই যেকোনো গুরুতর আঘাত বা রোগ, যা মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, তা ব্রেন ডেথের কারণ হতে পারে। আবার মস্তিষ্কের রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রক্তক্ষরণ হলেও একই পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

১. গুরুতর মাথায় আঘাত (ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি)

২. মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ)

৩. সাবঅ্যারাকনয়েড হেমোরেজ

৪. ইস্কেমিক স্ট্রোক

৫. হার্ট অ্যাটাক

৬. অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি (হাইপক্সিক ইস্কেমিক ব্রেন ইনজুরি)

৭. মেনিনজাইটিস বা এনসেফালাইটিসের মতো মস্তিষ্কের সংক্রমণ

কীভাবে ব্রেন ডেথ নির্ণয় করা হয়

‘মেডিক্যাল ক্রাইটেরিয়া’ বলতে বোঝায়, ব্রেন ডেথ নির্ণয়ে চিকিৎসকদের অনুসরণ করতে হওয়া নির্দিষ্ট ধাপগুলো। যুক্তরাষ্ট্রে এ ক্ষেত্রে তিনটি চিকিৎসা সংস্থা একসঙ্গে নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে।

১. পরীক্ষা শুরুর আগে চিকিৎসকেরা মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতির মূল কারণ শনাক্ত ও চিকিৎসা করেন।

২. যেসব সমস্যা বা অবস্থা ব্রেন ডেথের মতো উপসর্গ তৈরি করতে পারে, সেগুলো বাতিল করেন।

৩. ব্রেন ডেথের অনুকরণ করতে পারে, এমন সব পরিস্থিতি বাদ দেন।

এরপর প্রশিক্ষিত চিকিৎসকেরা একাধিক পরীক্ষা করেন। প্রাথমিক ফল নিশ্চিত করতে এসব পরীক্ষা একাধিকবারও করা হতে পারে। ব্রেন ডেথ সন্দেহ হলে রোগীর পরিবারের সদস্যদের আগে থেকেই জানানো হয় এবং প্রতিটি পরীক্ষার অর্থ ব্যাখ্যা করা হয়।

পরীক্ষার মধ্যে থাকে শারীরিক পরীক্ষা, ব্রেন এমআরআইয়ের মতো ইমেজিং টেস্ট, বিস্তৃত স্নায়বিক পরীক্ষা এবং অ্যাপনিয়া টেস্ট।

স্নায়বিক পরীক্ষা কীভাবে করা হয়

ব্রেন ডেথ হলে মানুষ শব্দ, আলো বা স্পর্শে স্বাভাবিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কোনো নড়াচড়া হলেও তা ইচ্ছাকৃত নয়। স্নায়বিক পরীক্ষার সময় চিকিৎসকেরা গলার পেছনে স্পর্শ করে গ্যাগ বা বমিভাবের প্রতিক্রিয়া দেখেন। তুলার সাহায্যে চোখে স্পর্শ করে পলক ফেলা বা চোখ বন্ধের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করেন এবং আলো ফেলিয়ে চোখের মণির প্রতিক্রিয়া যাচাই করেন।

অ্যাপনিয়া টেস্ট কী

মারাত্মক মস্তিষ্ক আঘাতের ক্ষেত্রে রোগী নিজে শ্বাস নিতে পারেন না এবং ভেন্টিলেটরের ওপর নির্ভরশীল হন। অ্যাপনিয়া টেস্টে কিছুক্ষণের জন্য ভেন্টিলেটর বন্ধ রেখে দেখা হয়, রোগী নিজে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেন কি না।

যদি পরীক্ষায় ব্রেন ডেথ ধরা পড়ে এরপর কী হয়

সব পরীক্ষার ফলাফল পরিবারের সদস্যদের বিস্তারিতভাবে জানানো হয় এবং স্পষ্ট করে বলা হয়, ব্রেন ডেথ মানেই মৃত্যু। চিকিৎসকেরা জানেন, এ খবর গ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই পরিবারকে সময় দেওয়া হয়, প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

এরপর পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। যেমন-ভেন্টিলেটর খুলে নেওয়া। প্রয়োজনে পরিবারের সদস্যরা ভেন্টিলেটর খুলে নেওয়ার আগে রোগীর পাশে কিছু সময় কাটানোর সুযোগও পান।

কোমা আর ব্রেন ডেথের পার্থক্য কী

কোমায় থাকা ব্যক্তি অচেতন থাকলেও কিছু প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন। যেমন- চোখে আলো ফেললে পলক ফেলা বা মাথা ঘোরানো। কোমা সব সময় স্থায়ী নয়; বেশিভাগ মানুষ দুই সপ্তাহের মধ্যেই কোমা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ব্রেন ডেথে কোনো প্রতিক্রিয়াই থাকে না। এটি সম্পূর্ণ ও স্থায়ী অবস্থা। ব্রেন ডেথ হলে আর কখনোই চেতনা ফিরে আসে না।

কেউ কি কখনো ব্রেন ডেথ থেকে সেরে উঠেছে?

না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ব্রেন ডেথ থেকে কেউ কখনো সেরে ওঠে না। কঠোর নির্দেশিকা মেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়। একবার ব্রেন ডেথ নিশ্চিত হলে সেই ব্যক্তি চিকিৎসাগতভাবে মৃত।

ব্রেন ডেথ কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?

না। কারণ যেসব গুরুতর অসুস্থতা বা আঘাত ব্রেন ডেথের দিকে নিয়ে যায়, সেগুলো অনেক সময় প্রতিরোধের বাইরে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা পেলে ব্রেন ডেথ ঠেকানো যেতে পারে। তবে একবার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিলে, তা আর ফিরিয়ে আনার কোনো চিকিৎসা নেই।

কঠিন বাস্তবতা

সাধারণভাবে আমরা মৃত্যু বলতে বুঝি শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, হৃদ্‌স্পন্দন থেমে যাওয়া। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভেন্টিলেটরের মতো যন্ত্র সাময়িকভাবে শ্বাস ও হৃদ্‌স্পন্দন চালু রাখতে পারে। এতে করে অনেক সময় বুঝে ওঠা কঠিন হয় যে ব্যক্তি দেখতে জীবিত, তিনি আসলে মৃত। চিকিৎসকেরা এই বাস্তবতা ভালোভাবেই বোঝেন। তাই ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার আগে তারা সব পরীক্ষানিরীক্ষা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করেন এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলেন।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © dainikkhobor.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com