শ্যামল কান্তি ভক্তের থেকে যাওয়া


আচ্ছা, একবার কি ভেবে দেখেছেন শ্যামল কান্তি ভক্ত কেন রয়ে গেলেন নারায়ণগঞ্জে, ও রকম জঘন্যভাবে অপমানিত হওয়ার পরেও?
ছোট শহরের স্কুলের হেডমাস্টার। স্থানীয় সমাজে নিশ্চয়ই শ্যামল কান্তি ভক্তের একটা পরিচিতি আছে। সেই তাঁকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো হলো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার বানোয়াট অভিযোগে। তারপরও তিনি রয়ে গেলেন সেই শহরেই। এখন সেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের প্রায়শ্চিত্ত করছেন নিশ্চয়ই, ঘুষ খাওয়ার উদ্ভট এক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জেলহাজতে বসে।
কেন শ্যামল কান্তি ভক্ত রয়ে গেলেন? তিনি কি বুঝে উঠতে পারেননি যে যাঁদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা কতটা প্রভাবশালী? তাঁদের ক্ষমতার নাগাল কত দূর?
নারায়ণগঞ্জ যাওয়া পড়েছে আপনার ইদানীং? গেলে দেখবেন, ওখানকার রাস্তায় রাস্তায় শামীম ওসমানের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। মনে হবে, নেলসন ম্যান্ডেলা আর মহাত্মা গান্ধীর মাঝামাঝি কেউ একজন। এমন একটা শহরে থেকেও ভক্তবাবু তাঁর আসন্ন বিপদের ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলেন না?
আমার কী মনে হয় জানেন? উনি ঠিক সেই কারণেই শহর ছাড়েননি, যে কারণে ১৯৭১ সালে দেশ ছেড়ে যেতে পারেননি মুনীর চৌধুরী। সমূহ বিপদ জেনেও দেশেই থেকে গেছেন শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, ড. আলীম চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ আরও অনেকে। তাঁরা শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক মানুষ। তাঁদের কাজ তো তাঁদের শহরে, তাঁদের দেশে। এই শহর, এই দেশ ফেলে তাঁরা যাবেন কোথায়?
তাঁরা ভেবেছেন, তাঁরা অন্যায় তো কিছু করেননি। বরং ভালো কিছু করার চেষ্টাই তো করে গেছেন চিরদিন। বোকা, আবেগপ্রবণ বাঙালি তো, এই পৃথিবীর বীভৎসতাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। যেমন পারেননি শ্যামল কান্তি ভক্ত।
আর এ-ই হচ্ছে আমাদের, মানে এই বোকা ও আবেগপ্রবণ বাঙালির ট্র্যাজেডি। এই দেশে রমেল চাকমারা বেঘোর মারা পড়বেন, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের উৎসব হবে, লেখকদের প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হবে, স্টক মার্কেট আর ব্যাংক থেকে জনগণের টাকা যথেচ্ছ লুটপাট হবে, শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করিয়েও পুরো সাধ না মেটাতে পেরে জেল খাটানো হবে। আর আমরা ভাবব, এ-ও তো মন্দের ভালো। আর যা হোক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তো অন্তত টিকে আছে। দেশ তো আমাদের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ!
এই শহরেই রয়ে যাব আমরা। এই দেশেরই মাটি কামড়ে পড়ে থাকব।
এবং এই পৃথিবীর বীভৎসতাটাকে আমরা ঠিক মেনে নিতে পারব না।
তানভীর হায়দার চৌধুরী: একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানর সিইও; শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সন্তান।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন