ঘুষ লেনদেনে নতুন স্টাইল বরংগাইল রেজিস্ট্রি অফিসে

প্রকাশ্যেই ঘুষ লেনদেন হচ্ছে মানিকগঞ্জের বরংগাইল সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে কত টাকার দলিলে কত টাকা ঘুষ নেয়া হবে সেটাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ঘুষ লেনদেনে অনিয়ম ঠেকাতে সাব রেজিস্ট্রার বিলকিস আরা দলিলপ্রতি টাকার অংকও নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
করায়কণ্ডায় ঘুষের টাকা বুঝে নেন এই নারী কর্মকর্তা। একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে ঘুষবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কেউ যদি কোনো কারণে কোনো দলিলে ঘুষ কম দিয়ে থাকেন তাহলে পরের দলিলে সই দেয়ার আগে বকেয়া ঘুষের টাকা বুঝে নেয়ার পর নতুন দলিলে সই দেন।

কথা হয় বরংগাইল সাব রেজিস্ট্রার অফিসের একজন দলিল লেখকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, এই সাব রেজিস্ট্রারের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। টাকা ছাড়া কোনো দলিলে সই করেন না তিনি। প্রতিবাদ করলেই সনদ বাতিলের হুমকি দেন। এ ছাড়া স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও দলিল লেখককে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। আমাদের বলা হয়েছে, এ সাব রেজিস্ট্রারের সঙ্গে উপরের যোগাযোগ ভালো। অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না।

বরংগাইল সাব রেজিস্ট্রারের বিভিন্ন অনিয়মের ব্যাপারে জেলা রেজিস্ট্রার শাহাদৎ হোসেন ভুঁইয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী একটি দলিল রেজিস্ট্রি করতে ১১ শতাংশ ফি দিতে হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে এই ফি পরিশোধের নিয়ম। সাব রেজিস্ট্রি অফিসে নগদ টাকা লেনদেনের কোনো সুযোগ নেই। বরংগাইল সাব রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সদর সাব রেজিস্ট্রার অহিদুল ইসলামকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেয়ার জন্য বলেন।

১৯ খাতে ঘুষের রেট : ২০১৫ সালে ৫ এপ্রিল যোগদানের পরই তিনি দলিল লেখকদের মৌখিকভাবে ১৯ খাতে ঘুষের রেট বুঝিয়ে দেন। এতে বলা হয়, কাগজপত্র থাকার পরও প্রতি সাবকবলা দলিলে লাখে ৩০০ টাকা, ঘরোয়া বা পারিবারিক সাব দলিলে অতিরিক্ত এক হাজার টাকা। এ ছাড়া মৌজাওয়ারি দিতে হবে আরও হাজার টাকা করে।

আমমোক্তার দলিলের জন্য কমপক্ষে দুই হাজার টাকা, মর্টগেজ দলিলে লাখে ৩০০ টাকা করে দিতে হবে। অথচ সরকারি মর্টগেজ ফি মাত্র ৫০০ টাকা। হেবা দলিলে সরকার নির্ধারিত ফি ৩৫০ টাকা নেয়ার বিধান থাকলেও তার রেট হচ্ছে লাখে ৩০০ টাকা। এ ছাড়া দলিল প্রহীতা অনুপস্থিত থাকলে তার জন্য দুই হাজার টাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পর্চা কাঁচা থাকলে সাব রেজিস্ট্রারের জন্য বাড়তি এক হাজার টাকা গুনতে হবে।
এ ছাড়া কমিশনের মাধ্যমে দলিল হলে উপজেলার অভ্যন্তরে অন্যান্য ফি’র বাইরে অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা, ক্ষেত্র বিশেষে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া কাঁচা পর্চার জন্য প্রতি দলিলের জন্য ৫০০ টাকা। বায়নাপত্র দলিলের জন্য বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা। দলিলের ভ্রম সংশোধনের রেট তিন হাজার টাকা। এদিকে হিন্দু ঘোষণা দলিলে ৩ শতাংশ টাকা গুনতে হয়।
এদিকে দলিলপ্রতি কথিত ‘সেরেস্তা ফি’ নামে আদায় করা হচ্ছে দুই হাজার টাকা করে। যদিও এই টাকার অর্ধেক যায় দলিল লেখকদের ফান্ডে।
কেস স্ট্যাডি : বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবী মাসুদ হাসান ১৮ এপ্রিল মানিকগঞ্জের বরংগাইল সাব রেজিস্ট্রি অফিসে আসেন মর্টগেজ দলিল করার জন্য। অফিসে গিয়ে সাব রেজিস্ট্রার বিলকিস আরার কোপানলে পড়েন।
নির্ধারিত ফি’র বাইরে ৭১ হাজার টাকা দাবি করলে এ নিয়ে সাব রেজিস্ট্রারের প্রধান অফিস সহকারী আবদুল হাইয়ের সঙ্গে আইনজীবী মাসুদ হাসানের বাকবিতণ্ডা হয়। শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের আইনজীবী হাসানের কাছ থেকে বাড়তি ২০ হাজার টাকা নেয়া হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের আইনজীবী হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারি এই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে ঘুষ দাবি তিনি দ্বিতীয়টি দেখেননি। খোলামেলাভাবে জোর জবরদস্তি করে ঘুষ আদায় চলছে এই অফিসে। এসব বন্ধ হওয়া উচিত। এটা অত্যাচারের পর্যায়ে চলে গেছে। এটা জুলুম।

ইসলামী ব্যাংকের আইনজীবী হাসানের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা প্রসঙ্গে পরে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের প্রধান অফিস সহকারী আবদুল হাই এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাব রেজিস্ট্রার ম্যাডামের নির্দেশে দলিল সম্পাদনের পরপরই টাকা বুঝে নিতে হবে। আর হিসাবনিকাশ দিতে হবে চলে যাওয়ার আগে। এখানে আমার নিজের করার কিছুই নেই। আমি বাহক মাত্র।

কথা হয় স্থানীয় ভুক্তভোগী শিবালয় উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘একটি জমি রেজিস্ট্রি করাতে গিয়ে গুনে গুনে আমাকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বরংগাইল সাব রেজিস্ট্রি অফিসের ঘুষের চিত্র পুরোপুরি আলাদা। এতটা প্রকাশ্যে এভাবে ঘুষ লেনদেন অন্য কোথাও হয় বলে আমার জানা নেই।

প্রকাশ্যে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ নিয়ে কথা হয় সংশ্লিষ্ট সাব রেজিস্ট্রার বিলকিস আরার সঙ্গে। ইসলামী ব্যাংকের আইনজীবীর রেকর্ডকৃত বক্তব্য শোনালে তিনি প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েন। পরে তিনি অফিসের প্রধান সহকারী আবদুল হাইকে ডেকে এভাবে প্রকাশ্যে ঘুষ না নেয়ার জন্য বলে দেন। তিনি আবদুল হাইকে বলেন, যদি কেউ খুশি হয়ে কিছু দেয় সেটা ভিন্ন জিনিস কিন্তু জোর করে যেন আর ঘুষ নেয়া না হয়।
নবীনতর পূর্বতন