রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি নিয়ে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ঢাকায় গার্মেন্টস মালিকরা বলেছেন, রাশিয়ার সাথে অর্থ লেনদেনে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় তাদের অনেকে আগের অর্ডার অনুযায়ী পণ্য প্রস্তুত করার পরও তা পাঠানো বন্ধ রেখেছেন।
বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি পণ্যের ৯৫ শতাংশই যায় তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে।
এদিকে, বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে শঙ্কা কাটানোর জন্য রাশিয়ার সাথে অর্থ লেনদেনে বিকল্প উপায়গুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একজন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক মোস্তাফিজুর রহমান রাশিয়ার একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্ডার পেয়েছিলেন ছয় মাস আগে।
সেজন্য তিনি আগাম ৩০ শতাংশ পেমেন্টও নিয়েছিলেন।
গত সপ্তাহে তার এক কন্টেইনার তৈরি পোশাক পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু মি: রহমান পণ্য পাঠাননি।
তিনি বলেছেন, একদিকে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানটি তাকে কিছু জানাচ্ছে না। অন্যদিকে পুরো পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সেজন্য তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে উল্লেখ করেন।
"রাশিয়ার যে ক্রেতার সাথে প্রায় দশ বছর ধরে ব্যবসা করি। তারা আমাদের খুব বিশ্বস্ত।
"আমরা গত সপ্তাহে প্রথম কন্টেইনার পাঠানোর ক্লিয়ারেন্স পাইনি। আমরাও পর্যবেক্ষণ করছি যে পরিস্থিতি কোন দিকে যায়," বলেন গার্মেন্টস রপ্তানিকারক মি: রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমানের মতো তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের অনেকেই রাশিয়ায় পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন।
'উদ্বেগজনক পরিস্থিতি'
রাপ্তানিকাররা বলছেন, দুই বছর ধরে রাশিয়ায় তাদের গার্মেন্টস রপ্তানি উর্ধ্বমুখী ছিল।
গত বছর তারা রপ্তানি করেছিলেন ৬০ কোটি ডলারের মতো।
এ বছর রাশিয়ায় ১০০কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির টার্গেট করেছিলেন গার্মেন্টস মালিকরা।
তারা মনে করছেন, এখন তা কোনভাবেই সম্ভব হবে না।
গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, রাশিয়ায় রপ্তানি নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তবে রাশিয়ার সাথে অর্থে লেনদেনে বিকল্প উপায় বের করতে তারা মালিকরা বাংলাদেশের অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে দুই দিন ধরে আলোচনা চালাচ্ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বিজিএমইএ নেতা মি: হাসান বলেন, "যারা পণ্যের শিপমেন্ট (জাহাজীকরণ) করে ফেলেছে বা শিপমেন্ট করার প্রক্রিয়ায় আছে, তাদের পেমেন্টটা বিকল্প পথে কীভাবে আনা যায়-সে কাজগুলো আমরা করছি।"
রাশিয়ার কিছু ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং তারপর 'সুইফট' থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিচ্ছিন্ন করার খবরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য।
এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকেই রপ্তানি হয়েছে ৬০কোটি ডলারের পণ্য।
রাশিয়ায় রপ্তানি সীমিত হওয়ার আশঙ্কা?
অন্যতম একজন অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, অর্থ লেনদেনের জটিলতায় এখন রাশিয়ায় রপ্তানি সীমিত হয়ে আসবে।
"কোভিড পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার বাজারে নতুন নতুন পণ্য রপ্তানির যে সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল, সেই সুযোগ শ্লথ হয়ে যাবে," বলছেন মিঃ মোয়াজ্জেম।
"গার্মেন্টস সহ যে সব (পণ্য) রপ্তানি হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে, সেগুলোর রপ্তানিও সীমিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।"
তবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, রাশিয়ায় রপ্তানির অর্থের বড় অংশই তৃতীয় দেশ সিঙ্গাপুরের মাধ্যমে আসে।
ফলে সেভাবে শঙ্কার কিছু নেই বলে তারা মনে করছেন।
এরপরও বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অর্থ লেনদেনের বিকল্প উপায় কী?
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মি: ইসলাম বলছেন, "রাশিয়ার যে সব ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে, তাদের কাছ থেকে পেমেন্ট পেতে হয়তো সমস্যা হবে। কিন্তু বাকি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কথা না।"
"বাংলাদেশে যে ব্যাংকগুলো রপ্তানি এবং আমদানির সাথে সম্পর্কিত, সেই ব্যাংকগুলোকে রাশিয়ার কিছু ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে এবং তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মি: ইসলাম।
তিনি বলেন, রাশিয়ার যে ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই, বিকল্প উপায় হিসাবে সেই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রপ্তানির অর্থ লেনদেন করতে হবে।
যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, রাশিয়ায় গার্মেন্টসসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানিতে অল্পসময়েই সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে, কিন্তু রপ্তানিকারকদের তাতে সন্দেহ রয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন