রাজধানীসহ সারা দেশে শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে অনুভূত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে হঠাৎ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনে। নরসিংদীর ঘোড়াশালকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট কম্পন কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলেও তার প্রভাব দেখা যায় আরও দীর্ঘক্ষণ। ভবন দুলতেই বাসাবাড়ি, অফিস এবং দোকানপাট থেকে মানুষ দ্রুত নিচে নামতে গিয়ে পড়ে যান, মাথা ঘুরে ভারসাম্য হারান—আঘাত পান নানাভাবে।
দিনভর আহতদের ঢল নামে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল)। দুপুরের পর থেকেই পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগীর চাপ দ্রুত বাড়তে থাকে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, বিকাল পর্যন্ত ভূমিকম্প–সম্পর্কিত আঘাতে ৯০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হলেও সন্ধ্যা নাগাদ সেই সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে অন্তত ১৮ জনকে ভর্তি করতে হয়েছে। রোগীর চাপ বাড়ায় অতিরিক্ত চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ড মাস্টার নিয়োগ করা হয় জরুরি বিভাগে।
হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স লক্ষ্মী রানী দাস জানান, ভূমিকম্পের আতঙ্কে আহত হয়ে অন্তত ৯০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। অনেকের হাত-পা ভেঙে গেছে, কারও কোমর ও কাঁধের জোড়া সরে গেছে, আবার অনেকে গুরুতর অস্থি–সংক্রান্ত আঘাত পেয়েছেন। রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসাসেবার চাপও বাড়ছে বলে জানান তিনি।
জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কেনান বলেন, দুপুর ১২টার পর থেকেই আহত রোগী আসতে শুরু করেন। বিকেল পর্যন্ত ১৫ জনকে ভর্তি করা হয়েছে, বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, হঠাৎ রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসক, নার্স এবং ওয়ার্ড মাস্টারের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা—মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, রামপুরা, হাতিরঝিল, বসুন্ধরা, পুরান ঢাকা—এবং আশপাশের জেলা থেকেও অনেক মানুষ চিকিৎসা নিতে পঙ্গু হাসপাতালে আসেন। প্রতিটি রোগীরই পেছনে রয়েছে একই গল্প—ভূমিকম্পে সৃষ্ট আতঙ্ক এবং সেই আতঙ্কে হুড়োহুড়ি করে নিচে নামতে গিয়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা।
কালাচাঁদপুর থেকে ৫০ বছর বয়সি এক ব্যক্তি দুপুর ১টার দিকে হাসপাতালে আসেন। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে তিনি কোমরে গুরুতর আঘাত পান।
আব্দুল্লাহপুরের ইয়াসিন আরাফাত দুপুর ২টায় হাসপাতালে ভর্তি হন; অফিসে ভূমিকম্পের সময় আলমিরা পড়ে তার ডান হাত ভেঙে যায়।
নতুন বাজার বেড়াইদের তানজিমা ফেরদৌস (৪০) মাথা ঘুরে পড়ে যান মেঝেতে এবং কোমরের নিচে আঘাত পান।
মিরপুর-৬ এলাকার মনিম সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে বাম পা ভেঙে ফেলেন।
নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের মুড়ি বিক্রেতা আবদুস সোবহান (৫৩) জানান, চায়ের দোকানে বসে থাকা অবস্থায় ভূমিকম্পের আতঙ্কে সবাই দৌড়ে গেলে তিনিও পড়ে গিয়ে বাম পা ভেঙে ফেলেন।
বসুন্ধরা এলাকার রাজমিস্ত্রি রবি ভূমিকম্পের সময় নিচে পড়ে কোমর ও বাম পায়ে আঘাত পান।
রামপুরার লিজা (৪০) সিঁড়ি থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন।
হাতিরঝিলের রোকেয়া (৫০) সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে তার বাম হাত ও কাঁধের জোড়া সরে যায়, যা সেরে উঠতে সময় লাগবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
পঙ্গু হাসপাতালের করিডোরজুড়ে তাই শুক্রবার ছিল আহত মানুষের দীর্ঘ সারি। প্রতিটি স্ট্রেচার, হুইলচেয়ার ও বেডে জমা হয়েছে আতঙ্কের ভিন্ন ভিন্ন গল্প।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভূমিকম্প–পরবর্তী পরিস্থিতি নজরদারি করছে এবং বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি মেডিকেল টিম সক্রিয় করা হয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ, আতঙ্কিত হয়ে হুড়োহুড়ি না করে নিরাপত্তা বিধি মেনে চলাই বাঁচার সর্বোত্তম উপায়।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পে শিক্ষার্থী ও শিশুসহ অন্তত ১৮ জন আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল পৌনে ১১টার দিকে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। পরে দুপুর ১২টার দিকে আহতদের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক। তিনি জানান, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ভূমিকম্পে আহত অন্তত ১৮ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। বর্তমানে সবাই ঢামেকের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন।