অনলাইন ডেস্ক:
“ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করাটা আমাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে। ফলে এটাকে মোকাবেলা করতেই হবে।”
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ‘ফল’ হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় আসীন হলেও তিনি জনগণকে ‘উপেক্ষা’ করে সেনাবাহিনী ও আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে ‘আঁতাত’ করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার।
তার ভাষ্য, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যেসব রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমাজে হাজির হয়েছে, সরকারপ্রধান হিসেবে তার মোকাবেলা না করে নির্বাচন দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইউনূস নাগরিকদের ‘বিপদে ফেলে চলে যাচ্ছেন’।
মব সহিংতা, মাজার ভাঙা, বাউলদের উপর হামলার ঘটনা যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর বেড়ে গেছে, তা অবধারিত ছিল বলেই মনে করেন ফরহাদ মজহার। তার মতে, রাষ্ট্রকে ‘নতুন করে গঠন করার প্রক্রিয়ায় না যাওয়াই’ এসব ঘটনা বাড়ার কারণ।
এক আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে তিনি বলেছেন, “সেক্যুলার ফ্যাসিজমের বিপরীতে মুদ্রার অপর পৃষ্ঠা হল ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। এটা হিন্দুত্ববাদের… মানে হিন্দুত্ববাদেরই ইসলামি সংস্করণ। এটা বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। এবং দেখবেন যে এদের কিন্তু সম্পর্ক ঠিক হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে। কারণ তাদের কিন্তু মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামকে ছোট করা।”
‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরা’ গণঅভ্যুত্থানকে ‘নস্যাৎ’ করে দিতে চাইছে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করাটা আমাদের প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য হিসেবে হাজির হয়েছে। ফলে এটাকে মোকাবেলা করতেই হবে।”
ইনসাইড আউটে বাংলাদেশের বাউল সংস্কৃতি, ইসলামে গানের চর্চা, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের পেছনে ইসলামপন্থি দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে ফরহাদ মজহার যেমন কথা বলেছেন, তেমনি আলোচনা করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান নিয়ে; প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনমুখী অবস্থানের সমালোচনা করেছেন তীব্র ভাষায়।
রোববার ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউবে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
মারাত্মক ভুল?
প্রধান উপদেষ্টা ‘জাতীয় ঐক্যের’ কথা বলে ‘এলিট সমঝোতাকে জাতীয় ইচ্ছা’ হিসেবে হাজির করছেন মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেছেন, “তাকে তো জনগণের কথা শুনতে হবে। কারণ গণঅভ্যুত্থানটা জনগণ করেছে, কোন রাজনৈতিক দল তো করে নাই। করেছে কি? বলুন।
“তাহলে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্র করছেন কেন? যারা লুটেরা মাফিয়া শ্রেণী। এরা তো লুট করবার জন্য আবার ক্ষমতা চায়। তিনি সমাজের যে প্রশ্ন, যে জিজ্ঞাসাগুলো, যে দ্বন্দ্বগুলো, এগুলার সংস্কারের জন্য তিনি কিচ্ছু করলেন না। এমনকি এই যে সাংস্কৃতিক বিরোধ আছে, তার জন্য কি তিনি কোন সংস্কৃতি কমিশন করেছেন? রাষ্ট্র গঠনের জন্য, এই সমাজকে বোঝানোর জন্য যদি তিনি করতেন, আজকে তো আমাদেরকে এই সংকটের মধ্যে পড়তে হতো না।”
এর বিপরীতে নির্বাচন দেওয়ার সমালোচনা করে ফরহাদ মজহার বলেন, “তিনি কি করেছেন? নির্বাচন দাও। তো নির্বাচন করলে কি আজকে এই যে উগ্র ধর্মবাদীরা যে উঠেছে, এটা সমাধান হবে? আমাকে বলেন তো আপনি। আমি ডক্টর ইউনূসকে প্রশ্ন করছি আপনার মাধ্যমে। উনি উত্তর দিন।
“উনি আমাকে বলবেন, আমি যখন কথা বলছি উনি পাবলিকলি বলবেন যে এভাবে যে আপনি এই যে এড়িয়ে চলে গেলেন জনগণের অভিপ্রায়, যেটা পাঁচই অগাস্ট এসেছিল, যার পরে আমি বারবারই বলেছি যে তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন।”
কী সেই মারাত্মক ভুল? মজহার বলেন, “আপনি সেনা সমর্থিত উপদেষ্টা সরকার বানিয়েছেন এবং আপনার আঁতাতটা সেনাবাহিনীর সঙ্গে, আপনার আঁতাতটা আন্তর্জাতিক শক্তির সঙ্গে। কিন্তু আপনার তো আঁতাত হওয়া ছিল জনগণের সঙ্গে।
“তো আপনি জনগণের সঙ্গে আঁতাতটা করলেন না কেন? আপনি আঁতাতটা করলেন ওই লুটেরা মাফিয়া শ্রেণির সঙ্গে, আন্তর্জাতিক পরাশক্তির সঙ্গে, আপনি আঁতাত করলেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কই, এটা তো আমরা তার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি নাই। তিনি তো গণঅভ্যুত্থানের ফল। তিনি তো গণঅভ্যুত্থানের নায়ক ছিলেন না।”
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধতা দিতে পরবর্তী সংসদের অনুমোদন লাগবে; ইউনূস সেই ব্যবস্থা করতে চাইছেন কি না– এমন প্রশ্নও তুলছেন ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “নতুনভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে তার (ইউনূস) ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। কই তিনি তো সেই ভূমিকা পালন করতে পারলেন না। আজকে আমাদেরকে তিনি বিপদে ফেলে চলে যাচ্ছেন। তো আপনি যে এই নির্বাচন করবেন, নির্বাচন কেন করবেন?
“এই সরকারকে বৈধ করতে হলে, আপনাকে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। তার মানে নির্বাচন হবে না, আপনি বেছে বেছে তাদেরকেই জিতিয়ে আনবেন যারা জাতীয় সংসদে গিয়ে এই সরকারকে বৈধ করতে ভোট দেয়। তো এই কাজটা কি আপনি ডিজিএফআইকে দিয়ে করাবেন? কাকে দিয়ে করাবেন?”
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আঙুল তুললেও ফরহাদ মজহার বলেন, তিনি নির্বাচনের বিপক্ষে নন।
“নির্বাচন তো আমরাও চাইছি। আমরা বলছি নির্বাচনটা আমরা চাই, কিন্তু সেই নির্বাচনটা হতে হবে গণপরিষদের নির্বাচন।
“যেখানে বাংলাদেশের এই যেগুলো (সংস্কার) আপনি আলোচনা করেছেন এই গণপরিষদের বাইরে, তারা যদি জিতে আসে তারা ঠিক করবে যে বাংলাদেশের আগামী দিনের গঠনতন্ত্র বা কন্সটিটিউশন কি হবে। আমাদের এখানে এই বিভিন্ন যেসব সংস্কার কমিশন আপনি বানিয়েছেন, এই সমস্ত সংস্কার কমিশনের তর্ক-বিতর্ক ওখানেই হবে।”
‘জনগণ নাই’ এমন আলোচনার পর এ সরকারকে কেন ‘সাংবিধানিক বৈধতা’ দেওয়া হবে–সেই প্রশ্নও তোলেন মজহার।
প্রধান উপদেষ্টা জনগণকে ‘ক্রমাগত উপেক্ষা’ করেছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, “উপেক্ষা করার কুফলটা আজকে আমাদেরকে সকলকে ভোগ করতে হচ্ছে।”
‘উগ্র ধর্মবাদ’, ইউনূসের ‘সৎসাহসের অভাব’
জনগণকে উপেক্ষার ‘কুফল’ হিসেবে ফরহাদ মজহার ‘উগ্র ধর্মবাদী গোষ্ঠী’র মাথা চাড়া দিয়ে উঠবার প্রচেষ্টার কথা বলছেন। এর বিরুদ্ধে সরকারপ্রধান হিসেবে যে ভূমিকা রাখবার কথা, তা না থাকাকে ‘সৎসাহসের’ অভাব হিসেবে দেখছেন তিনি।
তার ভাষ্য, “তার (ইউনূস) সেই সৎসাহস নাই যে এই উগ্র ধর্মবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। আমরা তো দাঁড়াচ্ছি।
“আমরা তো জানতাম বাংলাদেশের জনগণ এই ‘উগ্রতাকে’ পছন্দ করে না। আমরা এই ‘উগ্রতা’, এই ‘সহিংসতা’, এই ‘হিংস্রতা’—এটাকে তো আমরা বরদাস্ত করি না। ফলে ঠিক আছে, আমাদের মতো কিছু লোক যদি এই সামনে এই নিন্দা, মন্দ, আঘাত খেয়ে যদি আমাদের এই সপ্তকোটি মানুষ যদি বেঁচে যায়, তো অবশ্যই আমরা তার জন্য প্রস্তুত আছি।”
‘আল্লাহ ক্ষমা করেন, ধর্মীয় ফ্যাসিস্টরা করে না’
গতবছরের জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের সরকারের পতন ঘটে; তারপর থেকেই ‘মব জাস্টিস’ এর মত শব্দ মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে।
‘তৌহিদী জনতার’ নামে পাল্লা দিয়ে মাজার ভাঙা, কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলা, পালা গানের আসর বন্ধ করে দেওয়া, বাউলদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটতে থাকে দেশে।
এ বিষয়টিকে ফরহাদ মজহার ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ’ আকারে দেখে তাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ক্ষমার ব্যাপারটি না থাকাকে চিহ্নিত করেন, যেখানে আল্লাহ ও নবীর দেখানো পথ ছিল ক্ষমা।
তার ভাষ্য, “ইসলামে আন্তর্জাতিকভাবে তার যে একটা মহিমার দিক আছে, তার যে সমাজ গঠনে একটা নৈতিক, এথিকো-লিগাল দীর্ঘ তার একটা ট্র্যাডিশন আছে, ঐতিহ্য আছে; এটাকে সে (ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী) নস্যাৎ করে। কিসের ভিত্তিতে? মানুষের মত প্রকাশের অধিকারকে হরণ করে। অন্যকে কথায় তাকফির (অস্বীকার) করে, বা কথা কথায় মুরতাদ ঘোষণা করে।
“ইসলামে তো এগুলো নাই। রসূলের বিরুদ্ধে যতসব কটূক্তি করেছে, কত কিছু… অত্যাচার, নির্যাতন হয়েছে; তিনি তো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। এজন্য আমি বারবার বলি— আল্লাহ ক্ষমা করে, এরা (ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরা) ক্ষমা করে না। এই ফ্যাসিস্টদেরকে চেনা খুব সহজ। আল্লাহ ক্ষমা করেন, এই ধর্মীয় ফ্যাসিস্টরা কিন্তু ক্ষমা করে না। সে কারো কল্লা কাটে, কারো মাথা গুঁড়িয়ে দেয়, কাউকে পিটায়।”
এখন এসব ঘটনা বেশি ঘটার কারণ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘দুর্বল’ হিসেবে বর্ণনা করেন ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “আমার নাকি দাড়ি চেঁছে দেবে, দেখছেন না আপনি? তারা এইটা বলছে। তো এটা বলতে পারছে এবং দেখেন এই পরিস্থিতিতে এই সরকার, বিশেষত যে উপদেষ্টা সরকার, ‘এ তো দুর্বল’। …খুবই সতর্কভাবে চলতে হচ্ছে।
“আমরা তো সমালোচনা করছি। আমরাও কিছুটা বিপদে ফেলছি (সরকারকে) কিন্তু আমরা তো একটা ভিন্ন প্রশ্ন তুলছি যে গণঅভ্যুত্থানের পরে আমি রাষ্ট্র কি করে গড়ে তুলব। এরা (ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরা) তা চাইছে না কিন্তু। এরা পুরো গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছে।”
গান হারাম?
দেশের বিভিন্ন স্থানে বাউলদের ওপর যারা হামলা করছেন, তাদের কেউ কেউ যুক্তি হিসেবে বলছেন, ইসলামে গান ‘হারাম’।
তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে ফরহাম মজহার বলেন, “কোরআনের ব্যাখ্যা তো গান হারাম হয় না। এটা আপনার ব্যাখ্যা। একটা সময় গান হারাম করেছিল যেহেতু গানের মধ্য দিয়ে যে ধরনের বিনোদন হচ্ছিল, এটা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে না।
“খেয়াল করেন গান হারাম কেন? যদি তাকে আল্লাহ নিকটবর্তী করে না। কারণ গানটা তো একটা স্পিরিচুয়াল, একটা রুহানি কাজ। এর মধ্য দিয়ে তো আপনি আল্লাহকেই ডাকেন। আপনি তাহলে গান হারাম হলে আজান দিবার সময় গান করেন কেন? আজানে দিবার সময় সিন্ধু ভৈরবীতে কেন গাইতে হবে? রাগ তো হলো সিন্ধু ভৈরবী। তো ওই রাগে আপনি কেন গাইতে হবে?
“আপনি গান গাইয়া আপনি বলতেছেন, আপনি হুজুররা যখন ওয়াজ করে কতক্ষণ পর পর গান করে। তো আমি আপনি মুখে বলেন গান হারাম। তাহলে এই যে আপনার এই যে স্ববিরোধিতা, ‘উগ্রতার পক্ষে স্ববিরোধিতা’ ক্রমাগত, ‘অন্যায় জনগণের বিরুদ্ধে’—এটা তো গ্রহণ করতে পারেন না।”
ফরহাদ মজহার বলেন, “আকরাম খাঁ থেকে শুরু করে প্রচুর তাফসির আছে। তারা পরিষ্কারই বলেছেন, ইসলামে গান অবশ্যই এটা হারাম নয়। ইসলামে সেই গান হারাম, শুধু গান কেন, যেকোনো কিছু যা আমাদেরকে ধর্ম থেকে বিচ্যুত করে, এটা হারাম। মানে আজকে যারা এই যে উগ্রতা করছে, এটা তো হারাম ইসলামে। খালি গান একমাত্র হারাম কেন?”
বিজ্ঞান, রাষ্ট্রতত্ত্ব না জানা ‘আলেম বিপদজনক’
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে হাদিস, তফসির পড়ে যে ব্যাখ্যা এখানকার শিক্ষার্থীরা দাঁড় করান, তাদের রাষ্ট্রতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও দর্শনের শাখায় বিচরণ না থাকার কথা তুলে ধরে এ ধরনের ব্যাখ্যাকে রাষ্ট্রের জন্য ‘বিপদজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেন ফরহাম মজহার।
তিনি বলেন, “কিছু ব্যক্তি দাবি করতেছে আমি পড়ে আসছি মাদ্রাসা থেকে, আমি পড়ছি ফলে আমার দাবি গান হারাম। আরে ভাই মাদ্রাসায় তুমি পড়ছ। কোরআনে যখন ‘আলেম’ বলে, এ আলেমকে বলে জ্ঞানী ব্যক্তি। ওই মাদ্রাসা পাশ লোকের কথা বলে নাকি?
“তুমি তো আজকে দর্শন-টর্শন, ফিলোসফি, সায়েন্স, বিজ্ঞান কিচ্ছু তুমি পড়ো না, জানো না। ধারণা নেই। রাষ্ট্রতত্ত্ব কিচ্ছুই তুমি জানো না। তুমি কিসের আলেম? তুমি হাদিস মুখস্থ করেছ, খুব ভালো, আলহামদুলিল্লাহ। হাদিসের জন্য প্রতিযোগিতা লাগায় দিব তোমাকে। বাট তুমি তো রাষ্ট্রের ব্যাপারে, আইনের প্রশ্নে, সমাজ গঠনের প্রশ্নে তুমি তো ‘বিপদজনক’।”
এ শিক্ষার পরিচয় নিয়ে যারা বাউল বা বিভিন্ন ধারার লোকদের অত্যাচার করে, তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে হত্যার হুমকি দেয়, আইন হাতে নেয়, তাদের সমালোচনা করে এর বিপরীতে বরং বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের কথা বলেন মজহার।
তিনি বলেন, “তুমি তো ইসলামের মহিমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী না। তাকে তুমি ইসলামের মধ্যে, ইসলামের বলয়ে আনবার তো তুমি কোনো চেষ্টা করো না। আজকে দেখুন সারা বিশ্বে খ্রিষ্ট তত্ত্ব এত প্রবল দর্শনের কারণে, চিন্তার কারণে, আমরা তো না জেনেই সকলে খ্রিস্টান।
“আপনি যে আমাদের সমস্ত কিছু—আচার, ব্যবহার, পোশাক-আশাক, বাড়ি-ঘর, আর্কিটেকচার, খাওয়া-দাওয়া—এমনকি বাথরুমও পর্যন্ত সবই তো আমরা পাশ্চাত্যের নকল করি। তো আপনি তো খ্রিস্টান অলরেডি। তো এখান থেকে বের হতে হলে তো আপনাকে অবশ্যই এই দীর্ঘ একটা লড়াই লাগবে। সাংস্কৃতিক লড়াই, ইন্টেলেকচুয়াল লড়াই, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই আপনার লাগবে।”
সরকার আইন প্রয়োগে ‘অজ্ঞ’
‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের’ বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করলেও এটিকে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দমানোর পক্ষে নন ফরহাদ মজহার। এর মূলে সরকারের আইন প্রয়োগে ‘অজ্ঞতা’র কথা বলছেন তিনি।
নিজের অভিজ্ঞতা টেনে তিনি বলেন, “আমি ধরুন গোয়েন্দাদের বলেছি, এমনকি আমি ধরুন আমাদের যে আইজিপি আছেন বাহার সাহেব, তাকে বলেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে বলতে বলেছি। উপদেষ্টা যিনি আমাদের জাহাঙ্গীর ভাই, ভালো মানুষ ও খুব উদার প্রকৃতির মানুষ কিন্তু উনি তো আইন বুঝেন না। উনি তো আমাকে রক্ষা করতে পারছেন না।
“এই যে আমার বিরুদ্ধে বলতেছে আমার দাড়ি চেঁছে দিবে, আমাকে মেরে ফেলবে, হত্যাকাণ্ডের হুকুমের অধিকার চায়—কই উনি তো তাকে তো ধরলেন না। তো আইন তো শুধু আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন আপনি। কিন্তু আপনি এই ধরনের উগ্র ধর্মবাদী ফ্যাসিস্টদের আইনের আওতায় আনবেন না, এটা তো হয় না জাহাঙ্গীর ভাই। এটা তো হয় না।”
তার ভাষ্য, “আইন দিয়ে তো সমাধান করতে পারবেন না। ধরুন আজকে এনায়েতুল্লাহ খানকে, এই আব্বাসী, এই ধরনের উগ্র একটা সহিংস হিংস্র লোকটাকে আপনি গ্রেপ্তারও করেন, তো তাকে কেন্দ্র করে একটা বিরাট একটা জনমত গড়ে উঠবে অযথা। দরকার তো নাই।
“আর সেক্ষেত্রে আমরা তো ক্যাপাবল। আমরা তো এই ধরনের লোককে মোকাবেলা করতে পারি। আমাদের তো সমস্যা না।”
যে বা যারা হত্যার হুমকি দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন না বলে এক প্রশ্নের জবাবে জানান ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “ইস্যু তো আইন না, ইস্যু তো হচ্ছে অজ্ঞতারও। কারণ যেই মানুষটি এগুলো বলছে ও তো চূড়ান্ত অজ্ঞ লোক। ও তো ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানে না। কারণ ইসলাম সম্পর্কে যদি তার ন্যূনতম কোনো ধারণা থাকত, সে কি এভাবে ভাষা ব্যবহার করে?”
“…এই পুরো বিষয়টা আমাদের যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। ফলে আমাদের লড়াইটা আমি মনে করি না এটা আইনি। আপনার ওই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আইন দ্বারা এটা হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গিয়ে যদি এরকম একটা উগ্র সন্ত্রাসীকে যদি ধরে নিয়ে আসে, এতে আমার কোন লাভ নাই। আপনি তাকে হিরো বানাচ্ছেন, অযথা। ও তো হিরো না। ও তো একটা নিকৃষ্ট…। দরকার নাই আমার এটা।”
হেফাজতের ভূমিকায় ‘বিস্মিত’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে ‘ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ’ মোকাবেলায় ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ‘নেতিবাচক’ বলেই মনে করছেন ফরহামদ মজহার।
তিনি বলছেন, ২০১৩ সালের হেফাজতে ইসলামীর পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলেও তাদের এখনকার অবস্থানে তিনি ‘বিস্মিত’ হয়েছেন।
“কারণ এই হেফাজতে ইসলামের পক্ষেই তো আমি ধরুন ২০১৩ সালে ছিলাম। তাদের উপর যখন জুলুম হচ্ছিল, তাদের মানবাধিকার যখন লঙ্ঘন হচ্ছিল, একটা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাদের অবশ্যই কথা বলার অধিকার আছে। আপনি তার ১৩ দফা মানেন কি না মানেন সেটা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু আপনি তাকে কথা বলতে দিবেন।
“তারা চিড়া গুড় নিয়ে হেঁটে এসছে শহরে, তাদের খারাপ লেগেছে, তারা এসছে। তাদের বিক্ষোব করার অধিকার তো আপনি দিবেন। আপনি তাদেরকে কি করলেন? আপনি তাদেরকে সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে, গুলি করে বাচ্চা বাচ্চা মাদ্রাসার ছেলেকে আপনি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তো হেফাজত তো এই পর্যন্ত কোন কোন বাচ্চা কোথায় মারা গেছে, এখন পর্যন্ত একটা তালিকা দেয় নাই। তার মানে এর আগে ফ্যাসিস্ট শক্তির সঙ্গে তারা হাত মিলিয়েছিল।”
সে সময়কার ঘটনায় ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ করতে চাইলেও সেটি ‘ইসলামের নামে’ বাতিল করার সমালোচনা করে তিনি বলেন, “এরা আবার এখন নেমেছে বাউলদের বিরুদ্ধে। বাউলদেরকে একটা একটা বাউল ধরো, ধরে ধরে জবাই করো। তো তুমি শাপলাতে আমাদেরকে স্মৃতিচিহ্ন গড়তে দাও নাই কেন? তখন তুমি কিসের, ইসলামে কোথায় যে মিনার বানানো খারাপ, স্মৃতিচিহ্ন রাখা খারাপ—এটা কোথায় পেয়েছ?
“এই যে স্মৃতিচিহ্ন নষ্ট করাটা তো ইহুদিবাদ থেকে এসছে। যে ইসলামকে যদি আপনি বিনষ্ট করতে চান, তাহলে আপনার একমাত্র পথ হচ্ছে যেভাবে ইসলাম কায়েম হয়েছে বিভিন্ন দেশে, তার স্মৃতিচিহ্নগুলোকে ধ্বংস করা। এটা আপনি ইসরায়েলে দেখেছেন।”
হেফাজত হাসিনাকে ‘পুনর্বাসনের রাজনীতি’ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন বাংলাদেশে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এটাকে নস্যাৎ করে তারা আবার শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসিত করবে। এই হচ্ছে এদের রাজনীতি।”