ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে চলছে সমন্বিত অভিযান। অভিযুক্তরা যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য দেশের সীমান্ত এলাকায় তল্লাশি ও নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি। র্যাব এরই মধ্যে মাসুদের স্ত্রীর ভাই ও তার সহযোগী পলাশের ভাইকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। হাদি বর্তমানে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি আছেন। তার শারীরিক অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, গুলিবিদ্ধ হাদির পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে। মামলায় মোটরসাইকেল চালক ও তার পেছনে বসে যিনি গুলি করেছে তাকেও আসামি করা হবে। ওসমান হাদিকে গুলির সঙ্গে জড়িত আসামিদের ধরিয়ে দিতে পারলে তার জন্য সরকার ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
এদিকে ডিএমপির মতিঝিল জোনের এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার তদন্তে এখন পর্যন্ত ‘বিশেষ অগ্রগতি’ হয়েছে। তবে সন্দেহভাজন অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এমন তথ্য নেই। অভিযুক্ত মাসুদ পালাতে পারেননি। বিভিন্ন স্থানে অভিযান ও খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্তের বাসাসহ অন্তত পাঁচটি জায়গা লোকেট করা হলেও সেখানে তাকে পাওয়া যায়নি। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, অভিযুক্ত একাধিক মোবাইল ফোন ও নম্বর ব্যবহার করছিলেন এবং বারবার নম্বর পরিবর্তন করেছেন। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালানো হলেও এখনো নিশ্চিত কোনো অবস্থান পাওয়া যায়নি। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হাদিকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন ভাড়া করা সন্ত্রাসী আলমগীর হোসেন। আর মোটরসাইকেল চালিয়ে হাদির রিকশার কাছিকাছি নিয়ে যান ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে রাহুল (৩৭)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই দু’জনকে চিহ্নিত করতে পারলেও গতকাল রাত ৯টা পর্যন্ত কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। তারা দেশের ভেতরেই অবস্থান করছেন। যে কোনও সময় তারা গ্রেফতার হতে পারে বলেও জানা যায়।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক বা কোনও বিদেশী চক্র এই কিলিং মিশনে অংশ গ্রহণ করে থাকলে কিলারদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। তবে আপাতদৃষ্টিতে এবং গোয়েন্দাদের তদন্তে তারা আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। যদিও ফয়সাল আদাবর থানার ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তবে কিলার আলমগীরের রাজনৈতিক কোনও পরিচয় এখনো জানা যায়নি। ডিএমপির ডিবি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মূল সন্দেহভাজনকে ধরতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এজন্য সবার সহযোগিতা দরকার।
পুলিশের ধারণা, গত শুক্রবার হাদির ওপর বন্দুক হামলার আগে থেকেই তার সব সিডিউল, সহচরদের ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা নিয়েছে কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া প্রত্যেকেই। এখানে কেউ করেছে তথ্য দেওয়ার কাজ, কেউ অস্ত্র বহন করেছে আবার কেউ ছিলো ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে। এসব বিষয়ে কথা হয় শরিফ ওসমান হাদির রাজনৈতিক সহচর ও ইনকিলাব মঞ্চের আরেক মুখপাত্র নাঈম ইবনে জহিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ফয়সাল, রুবেল ও জাহাঙ্গীর নামে তিনজন গত দুই শুক্রবার হাদি ভাইয়ের সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে ছিলেন। গত পাঁচ ডিসেম্বর ফয়সালসহ বাকিরা ইনকিলাব মঞ্চের অফিসে আসেন। তারপর হাদি ভাইকে বলেন, আমরা আপনার সঙ্গে নির্বাচনী গণসংযোগে থাকতে চাই। হাদি ভাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাদের দলে নেন। পাঁচ তারিখের পর গত শুক্রবার দ্বিতীয়বারের মতো তারা গণসংযোগে এসেছিলো।
সর্বোত্তম চিকিৎসার আশ্বাস প্রধান উপদেষ্টার: হাদির সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল শনিবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথিভবন যমুনায় হাদির পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতকালে তিনি বলেন, সারাদেশ তার জন্য দোয়া করছে। তার সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিতে সবাই চেষ্টা করছে। তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় যদি দেশের বাইরে পাঠাতে হয়, যেখানে পাঠানোর প্রয়োজন হবে সরকার সেখানেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।
হাদির অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক: মেডিকেল বোর্ড: সন্ত্রাসীদের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন ওসমান বিন হাদির বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানিয়েছে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড। বোর্ড থেকে বলা হয়েছে, ওসমান হাদির মস্তিষ্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেহেতু অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে সেহেতু এখন কনজারভেটিভভাবেই ম্যানেজ করতে হবে। তার কিডনির কার্যক্ষমতা ফেরত এসেছে। তবে সার্বিকভাবে তার অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। শনিবার মেডিকেল বোর্ডের এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ওসমান হাদিকে শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল থেকে অপারেশনের পরে এভারকেয়ার হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। মেডিকেল টিমের পক্ষ থেকে হাদির জন্য বিনীতভাবে দোয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
জড়িতদের শিগগিরই গ্রেফতার -ডিএমপি কমিশনার: হাদিকে হত্যাচেষ্টায় জড়িতদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, আমরা খুঁজতেছি, প্রাইম সাসপেক্টকে খুঁজতেছি। হোপফুলি আমরা হিট করতে পারবো। আমরা জনগণের সহযোগিতা চাইছি। হাদির ওপর হামলার ঘটনায় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
হামলাকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার: ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। শনিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে তিনি এ কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনা জাতীয় নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য ঘটানো হয়েছে।
সন্দেহভাজন একজনকে শনাক্ত তথ্য দিতে অনুরোধ: ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তার ব্যাপারে তথ্য দিতে সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি। ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের খুঁজতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। শনাক্ত ব্যক্তির সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকলে পুলিশকে জানাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যোগাযোগের জন্য তিনটি মুঠোফোন নম্বর জানিয়েছে পুলিশ। এগুলো হলোÑ ০১৩২০০৪০০৮০ (মতিঝিলের উপকমিশনার), ০১৩২০০৪০১৩২ (পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ও ৯৯৯ নম্বর। তথ্যদাতার পরিচয় গোপন থাকবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সীমান্তে বিজিবির সতর্কতা জারি: ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের কেউ যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সেজন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বেনাপোল ও সিলেটসহ দেশের সকল সীমান্তে সতর্কতা জারি করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বিজিবি সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, হাদির গুলির ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে সারাদেশে আইন-শৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের অভিযান চলছে। গুলির ঘটনায় জড়িতরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে পারে এমন আশংকা রয়েছে। এ জন্য দেশের সকল সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার এবং তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে।
বিজিবি-২৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জাব্বার আহমেদ বলেন, ‘বিজিবি সদর দফতরের নির্দেশনায় ২৫ ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, বিজয়নগর এবং হবিগঞ্জের ধর্মঘর সীমান্তে টহল কার্যক্রম স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই অবৈধভাবে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে না। ২৫ বিজিবির আওতাধীন প্রত্যেকটি বিওপির সদস্যরা সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। যশোর ব্যাটেলিয়ান (৪৯ বিজিবি) সূত্র জানিয়েছে, ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ মেইন পিলার ১৮/১ এস থেকে ৪৭/৩ এস পর্যন্ত প্রায় ৭০.২৭৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কড়া তল্লাশি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বাড়ানো হয়েছে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি। এছাড়াও সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত বিজিবি।
৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী জানান, ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় জড়িতরা যাতে কোনোভাবেই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালাতে না পারে, সেজন্য বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সীমান্তের প্রতিটি পয়েন্টে তল্লাশি কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বেনাপোল আইসিপি, আমড়াখালি, সাদীপুর, রঘুনাথপুর, ঘিবা, শিকারপুর, শালকোনা, কাশিপুর, মাসিলা, আন্দুলিয়া এবং পাঁচপিসতলা এলাকাসহ সীমান্তসংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য। সকাল থেকেই এসব এলাকায় যানবাহন ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভির ফুটেজ ও পুলিশ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য বলছে, দুপুর ২টা ২০ মিনিটে গুলি করার শব্দ শোনা যায়। এর কয়েক সেকেন্ড পর মোটরসাইকেলে করে দুই যুবক দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পুলিশ বলছে, তিনটি মোটরসাইকেলে করে দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থলে আসে। এর মধ্যে একটি মোটরসাইকেল থেকে হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। তিনি এ সময় রিকশায় করে যাচ্ছিলেন।