December 1, 2025, 8:23 am
সর্বশেষ সংবাদ:
‘সমুদ্রে অবৈধ ও অতিরিক্ত মৎস্য আহরণে মাছের সংস্থান কমে যাচ্ছে’ দেশের ৩৩ শতাংশ মানুষ রোগাক্রান্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের একমাত্র সমাধান: পোপ লিও সশস্ত্র বাহিনীর বঞ্চিত সদস্যদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে সরকার: প্রধান উপদেষ্টা বেলুচিস্তানে এফসি সদর দপ্তরে হামলা, পাল্টা হামলায় ৩ সন্ত্রাসী নিহত হঠাৎ পাল্টে গেলো বাংলালিংকের লোগো, সামাজিকমাধ্যমে চলছে আলোচনা কক্সবাজারে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা এবং কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার সঙ্গে এবার রেহানা-টিউলিপের রায় সোমবার খালেদা জিয়ার অসুস্থতার জন্য হাসিনা সরকার দায়ী: রাশেদ খান খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল, কিছুটা ভালোর দিকে: তথ্য উপদেষ্টা

বিশ্ব চালাবে কে—চীন নাকি ইউরোপ

Reporter Name
  • Update Time : Thursday, April 10, 2025
  • 46 Time View

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কহার ১৯০৯ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দরাজ গলায় ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আজ আমরা একটি যুগে আছি। কাল নতুন একটি যুগে পা রাখব।’ তিনি বলেছেন, ‘আমরা এমন কিছু করেছি, যা আগে কেউ কখনো করেনি!’

১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর চেয়ারম্যান মাও সে–তুং বেইজিংয়ের নিষিদ্ধ নগরীর প্রবেশদ্বারখ্যাত তিয়েনআনমেনের ওপর দাঁড়িয়ে চীনের ‘মুক্তি দিবস’ ঘোষণা করেছিলেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এর পর থেকে বিশ শতককে দুটি ভাগে ভাগ করে। একটি ভাগ হলো চিয়াং কাইশেকের শাসনকালের ‘মুক্তির আগের সময়’ এবং অন্য ভাগটি হলো মাও সে–তুংয়ের শাসনকালের ‘মুক্তির পরের সময়’। ‘মুক্তির পরের সময়’ চীন তিন দশকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে নিমজ্জিত ছিল।

এখন ট্রাম্পের ‘মুক্তি দিবস’ বিশ্বব্যাপী সে ধরনেরই অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বয়ে আনতে পারে। ইউরোপীয়দের জন্য এটি যেন হঠাৎ সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার মতো। ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা তার স্থিরতা ও পূর্বানুমেয়তা হারিয়ে ফেলেছে। গ্রহগুলো যেন কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ছে। একসময় যে ইউরোপীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করত, তারা এখন নিজেদের সম্পূর্ণ একা ভাবতে শুরু করেছে। তারা এমন এক মার্কিন নেতার মুখোমুখি হয়েছে, যিনি অজ্ঞতা ও নির্লজ্জতার চূড়ান্ত রূপ নিয়ে হাজির হয়েছেন।

পুরোনো ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে চীন ও রাশিয়া এখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে প্রস্তুত। এর মধ্যে এক দেশ হলো অস্ত্রভান্ডার, বিশাল ভূখণ্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদসমৃদ্ধ একটি দুর্বল অর্থনীতির অধিকারী মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী শাসনাধীন, যার অর্থনীতি কানাডার চেয়ে ছোট। আর অন্যটি হলো পুনরুজ্জীবিত একদলীয় লেনিনবাদী রাষ্ট্র, যার রয়েছে বিশাল অর্থনীতি, সংবেদনশীল নেতা এবং একটি দ্রুত বিকাশমান বৈশ্বিক প্রযুক্তিকেন্দ্র।

এই যখন অবস্থা, তখন ইউরোপ কি সত্যিই এমন এক বিশ্ব চায়, যেখানে স্বৈরতন্ত্র নিরাপদ থাকবে?

সান ইয়াৎ-সেন একসময় বলেছিলেন, ইউরোপ যদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আলগা বালুর মতো থাকতে না চায়, তাহলে শুধু সামরিক শক্তি বাড়ানোই যথেষ্ট নয়, তাকে গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখতে হবে।

মাও সে–তুং এই ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তন’ কৌশলকে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক মনে করতেন। কারণ, এটি চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সি চিন পিংও সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি’ হিসেবে দেখে আসছেন। এটি করতে হলে ইউরোপের নিজস্ব যেসব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রয়েছে, তা তারা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। যেমন ফ্রান্স ও ব্রিটেনের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে এবং সেগুলো ইউরোপের জন্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। জার্মানির রাইনমেটাল নামের প্রতিষ্ঠান অস্ত্র তৈরি করে আর ইউক্রেন ড্রোন প্রযুক্তিতে দক্ষ। এটি ইউরোপের সামরিক খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিএই সিস্টেমস এবং ফ্রান্সের এয়ারবাস সামরিক সরঞ্জাম ও বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। নেদারল্যান্ডসের এএসএমএল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার উন্নত মাইক্রোচিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইইউভি প্রযুক্তির ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এসব সম্পদকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপ যদি চায়, তবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে একত্র করতে পারে।

কিন্তু ইউরোপ এখনো সেই ধরনের সহযোগিতামূলক জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করেনি। যদি তারা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে, তাহলে চীন বুঝতে পারবে, যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে বিশ্ব কেবল তাদের জন্য উন্মুক্ত নয়।

ট্রাম্পের ন্যাটোবিরোধী মনোভাবের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপীয় ও এশীয় গণতন্ত্রপন্থীদের উচিত তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে একে অপরের সঙ্গে নতুন ধরনের অংশীদারি গড়ে তোলা। ভারত বরাবরই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সংবেদনশীল। তাই ভারত এ ধরনের প্রচেষ্টায় সহযোগী হতে পারে।

একসময় ফরাসি নেতা শার্ল দ্য গল ফ্রান্সের জন্য এই কাঠামোই কল্পনা করেছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পর দ্য গল আশঙ্কা করেছিলেন, সোভিয়েত আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইউরোপকে রক্ষা করতে আসবে না। তিনি স্পষ্টভাবেই আমেরিকানদের বলেছিলেন, প্যারিসকে বাঁচানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্ককে বলি দেবে, এমন কথা তিনি বিশ্বাস করেন না।

এ কারণে দ্য গল ফ্রান্সের নিজস্ব পারমাণবিক বাহিনী ‘ফোর্স দ্য ফ্রাপ’ গড়ে তোলেন এবং ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে ফ্রান্সকে প্রত্যাহার করেন (যদিও ফ্রান্স ন্যাটোর সদস্যপদ বজায় রাখে)। তখন অনেকে তাঁর পদক্ষেপকে শিশুসুলভ জেদ বলে মনে করেছিল। কিন্তু তাঁর যুক্তি এখন যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন দীর্ঘদিন ধরে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আলোচনা, সংলাপ, বাণিজ্য চুক্তি, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। তবে এসব কৌশল চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নেতাদের মনোভাব বদলাতে পারবে না। তাঁরা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে চান না, বরং তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণ করতে চান এবং তারপর সেই বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে বদলে দিতে চান।

একসময় মাও সে–তুং বলেছিলেন, ‘ধ্বংস ছাড়া বিনির্মাণ সম্ভব নয়।’ তাঁর এ কথার মধ্যে কিছু সত্য রয়েছে। ট্রাম্পও একধরনের ধ্বংসের কাজ করছেন। তবে যদি ইউরোপ সঠিকভাবে সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে, তাহলে ট্রাম্পের নীতিই পরোক্ষভাবে এমন এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার জন্ম দিতে পারে, যা আর আমেরিকাকেন্দ্রিক থাকবে না।

কিন্তু ইউরোপীয়দের মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই একবার এমন কৌশল প্রয়োগ করেছে। সে কৌশল তারা শুধু সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করেছে, তা নয়; বরং চীনের বিষয়েও তারা একই কৌশল নিয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে ১০ মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে নানা কৌশল অবলম্বন করেছেন।

কিন্তু এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বরাবরই মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা মুখে যা-ই বলুন না কেন, যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের একদলীয় শাসন উচ্ছেদ করতেই চায়। তারা প্রায়ই প্রেসিডেন্ট ডুয়াইট আইজেনআওয়ারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের ১৯৫৩ সালে বলা সেই কথা মনে করিয়ে দেন, যেখানে ডালেস বলেছিলেন, ‘মুক্তি’ কেবল যুদ্ধের মাধ্যমেই নয়, বরং ‘অভ্যন্তরীণ চাপের মাধ্যমে’ও অর্জন করা সম্ভব, আর সেটিই কমিউনিস্ট শাসনকে তার চরিত্র পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে।

মাও সে–তুং এই ‘শান্তিপূর্ণ বিবর্তন’ কৌশলকে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক মনে করতেন। কারণ, এটি চীনের কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সি চিন পিংও সব সময় যুক্তরাষ্ট্রকে ‘শত্রুভাবাপন্ন বিদেশি শক্তি’ হিসেবে দেখে আসছেন।

তাই ইউরোপের চীন সম্পর্কে কোনো ভ্রান্ত ধারণা না রাখা উচিত। সাহসী প্রতিরোধ, জোটগত ঐক্য এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমেই আজকের আত্মবিশ্বাসী স্বৈরতন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্ব গণতন্ত্রের এই দায়িত্ব নিতে না চায়, তাহলে ইউরোপেরই সেই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। অন্য কেউ তা করবে না।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © dainikkhobor.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com